“টম একের পর এক নানান ফন্দি আর চক্রান্ত করতেই থাকে জেরিকে মুঠোবন্দি করার জন্য কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন ভাবে পার পেয়ে যায় চালাক আর দুষ্ট জেরি।”
৯০ এর দশক, আমাদের শৈশবের সে সময়টাতে নানান গেমস ভর্তি কোন স্মার্টফোন ছিলনা। ছিলনা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব এসবের কিছুই। টেলিভিশন আর ডিস চ্যানেল এর কার্টুনগুলোই তখন আমাদের কাছে সব। চমৎকার সব কার্টুন আর তাদের চরিত্রগুলো ঘিড়েই ছিল আমাদের সকল আনন্দ। কি এক সময়ই না ছিল তখন! সে সময়ে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হত, “তোমার পছন্দের কার্টুন কোনটি?” যে কেউই এক নিঃশ্বাসে বলে দিত “টম এন্ড জেরি”!
পছন্দের একদম শীর্ষে না থাকলেও যে কারো পছন্দের তালিকায় থাকবেই এই “টম এন্ড জেরি”। এ দুটি চরিত্রই আমাদের কাছে এত আপন যে, এদেরকে আঁকড়ে ধরেই কেটে গেছে আমাদের শৈশবের অনেকটা সময়। তাদের ঠাট্টা তামাশা আর একের পর এক নানান কান্ড কারখানা দিয়ে ঠাসা প্রতিটি পর্বই আমাদের হাসি আর আনন্দের উদ্রেক করত, যা আমাদের শৈশবের দিনগুলিকে করে রেখেছিল অনেকবেশি আনন্দময়। শুধু আমাদের সময়টাই না, টম এন্ড জেরি এমনই এক কার্টুন যা যুগের পর যুগ ছোট থেকে বড় অসংখ্য মানুষেরই অসম্ভব প্রিয় ছিল।

আচ্ছা, শুরু থেকেই কি “টম এন্ড জেরি” সকলের এত প্রিয় ছিল? আর কেনইবা চরিত্র দুটি সবার এত প্রিয়, কি ছিল চরিত্র দুটিতে? চরিত্র দুটির পিছনেই বা কারা ছিলেন? প্রিয় কার্টুন এর এসব নানান তথ্য গুলোই আজকে আমরা জানব!
খুবই আয়েশী আর আরামপ্রিয় নীল সাদার মিশেলে পোষা এক বিড়াল টম। সারাক্ষণই সে তাড়া করে বেড়ায় বাদামী রঙা ছোট্ট কিন্তু ভীষণ দুষ্ট এক ইঁদুর জেরিকে। জেরি আর টম একই বাড়িতে থাকে। সে বাড়ির মজার মজার সব খাবার চুরি করে খাওয়া জেরির খুবই পছন্দ। টম একের পর এক নানান ফন্দি আর চক্রান্ত করতেই থাকে জেরিকে মুঠোবন্দি করার জন্য কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন ভাবে পার পেয়ে যায় চালাক আর দুষ্ট জেরি। সারাবাড়িতে দৌড় ঝাপ আর ভাংচুড় এর জন্য টমকে প্রতিদিনই ধমক খেতে হয় নিজ মালিকের কাছে, এছাড়া নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ভয়ংকর রাগী এক বুলডগের পিটুনিও প্রায়ই খেতে হয় বেচারা টমকে।

এভাবে নাস্তানাবুদ হতে থাকার পরও জেরিকে তাড়া করে বেড়ানোতেই যেন তার সব আনন্দ। যদিও টম যে একদম অযথাই জেরিকে তাড়া করে বেড়ায় তা কিন্তু না, জেরিও সমানতালে ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ টমকে উত্যক্ত আর যন্ত্রণা দিতে, এসবের জন্য টমের ঘুম আর আরামের সময়গুলোই বেশি বেছে নেয় দুষ্ট জেরি। এছাড়াও কিছু পর্বে টমকে পেটে ক্ষুধা নিয়ে জেরিকে ধাওয়া করতে দেখা গেছে এবং জেরিকে পাঊরূটির মধ্যে ভরে খাওয়ার চেষ্টাও টম করেছে। মারামারি আর ঝগড়া করলেও তাদের মধ্যে ঠিকই এক ধরনের বন্ধুত্ব ছিল। কেউ একজন বিপদে পড়লে অন্যজন ঠিকই সাহায্যের সর্বাত্নক চেষ্টা করতে থাকে। টম আর জেরির এসব কান্ড কারখানা দেখার জন্যই টেলিভিশনের পর্দার দিকে কত হা করে তাকিয়ে থেকেছি, চোখের পলকও ফেলিনি এক মুহূর্তের জন্য।
অসম্ভব জনপ্রিয় এই টিভি কার্টুনটির মূল নির্মাতা হচ্ছেন উইলিয়াম ডেনবি হ্যানা (William Hanna) ও জোসেফ বারবারা (Joseph Barbera)। এই নির্মাতারাও ভাবেনি যে কার্টুনটি এত জনপ্রিয় হবে, এমনকি “টম এন্ড জেরি”র নামও শুরুতেই কিন্তু “টম এন্ড জেরি” ছিলনা।

১৯৩৯ সালের কথা, প্রযোজক রুডলফ আইজিং (Rudolf Ising) ও তার এনিমেশন স্টুডিও ইউনিট এমজিএম (MGM) কিছুটা ব্যবসায়িক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কারন তাদের শেষ কার্টুন সিরিজ “ক্যাপ্টেন এন্ড দ্যা কিডস” অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয়তা পাওয়ায় স্টুডিওটি অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অভিজ্ঞ পরিচালক উইলিয়াম হ্যানা এবং গল্পকার ও চরিত্র ডিজাইনার জোসেফ বারবারাও এমজিএম (MGM), মেট্রো গোল্ডেন মায়ার্স স্টুডিওর একই ইউনিট এ কাজ করতেন। তারা দুইজনই অসম্ভব প্রতিভাবান এবং পরস্পরের ভালো বন্ধু ছিলেন। এরপরই প্রযোজক রুডলফ আইজিং এইদুইজনের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করেন। রুডলফ এই দুইজনকে নিয়ে আলোচনায় বসলে তারা বিড়াল ও ইঁদুর এর ধারনাটি দেন এবং এইদুইজনকে প্রধান চরিত্র করে কার্টুন বানানোর প্রস্তাব দেন। যদিও আইডিয়াটি তাদের অন্যান্য সহকর্মীদের খুব একটা পছন্দ হয়নি কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্টুডিওটি ১৯৪০ সালে একটি বিড়াল ও একটি ইদুরকে প্রধান চরিত্রে রেখে “পুস গেটস দ্যা বুটস” নামের একটি কার্টুন বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় যেখানে টম এন্ড জেরি “জ্যাস্পার এবং জিঙ্কস” নামে উপস্থাপিত হয়।
যদিও টম এন্ড জেরির আসল ফ্রাঞ্চাইজি এটা ছিলনা, কিন্তু গল্পের প্লট ও চরিত্র গুলো ছিল অনেকটা একই রকম। বিড়াল আর ইদুর এর কাণ্ডকারখানা নিয়ে নির্মীত কার্টুনটি সে সময়ের দর্শকদের মনে ধরে যায়, ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে যখন “পুস গেটস দ্যা বুটস” একাডেমিক এওয়ার্ড এর জন্য মনোনয়ন পায় তখনই এমজিএম কতৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেন। যদিও একাডেমি এওয়ার্ড এর চূড়ান্ত পর্বে এসে হেরে যায় “পুস গেটস দ্যা বুটস”। এরপরই মেট্রো-গোল্ডেন-মায়ার এর অন্যতম প্রযোজক ফ্রেড কুইম্বি (Fred Quimby) উইলিয়াম হ্যানা আর জোসেফ বারবারা কে জরুরী তলব করে এই বিড়াল আর ইঁদুর এর আইডিয়াটি আরো উন্নত করার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজী হয়ে তারা “জ্যাস্পার এবং জিঙ্কস” এর কিছু পরিবর্তন করে “টম এন্ড জেরির” সূচনা করেন। দুইজনের অসাধারন প্রতিভার সমন্বয়ে তৈরী হয় এমজিএম স্টুডিওর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল কার্টুন সিরিজ “টম এন্ড জেরি”। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি।

১৯৪০ সালেই “টম এন্ড জেরি”র প্রথম প্রচার শুরু হয়ে একটানা চলে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ ১৮ বছরের এই সময়ে তাদের জনপ্রিয়তার একটুও ভাটা পরেনি। এই সময়ের মধ্যে টম এন্ড জেরির পর্বগুলি এনিমেটেড কার্টুন এর ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আর্থিকভাবে সফল শর্ট এনিমেটেড ফ্রাঞ্চাইজি হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, টানা ১৮ বছর চলাকালীন সময়ে এই জুটি ১৩ট বার একাডেমিক পুরষ্কার এর জন্য মনোনিত হয়। জিতে নেয় ৭টি অস্কার সহ বেশ কিছু পুরষ্কার যা ছিল কোন ইতিহাসের যে কোন এনিমেটেড চরিত্রের চেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে হ্যানা আর বারবারা মিলে প্রায় ২০০টির মত পর্ব তৈরী করেছিলেন যা তাদের এখনো অমর করে রেখেছে।
অসামান্য এই সাফল্যের পথে বাধা যে আসেনি তা কিন্তু না। প্রথমদিকে বাজেট কম থাকায় খুব বেগ পেতে হয়েছিল হ্যানা আর বারবারার। লোকজন বিড়াল আর ইদুর নিয়ে হাসিঠাট্টাও কম করেনি। তবুও হ্যানা আর বারবারার অদম্য ইচ্ছার কারনে থেমে থাকেনি তাদের কার্টুন বানানো। অতিরিক্ত ভায়োলেন্স এর অভিযোগ ও আনা হয় টম এন্ড জেরির বিরুদ্ধে। নানান সময়েই দেখা যেত টম আর জেরি একজন অন্যজনকে ঘায়েল করার জন্য লাঠি, কুড়াল, করাত সহ ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যাবহার করছে যা সত্যিই ভায়োলেন্স এর উদ্রেক করছে। এমনকি টম এন্ড জেরির অন্যতম লেখক জেন ডিচ (Gene Deitch) ও এই অভিযোগের পক্ষে ছিলেন।

দর্শক কিন্তু এগুলোই উপভোগ করত, একজন অন্যজনকে ভয়ংকর সব আঘাত করার পরেও তারা বেচে যাচ্ছে, উঠে দাড়াচ্ছেঃ কেউ মারা যাচ্ছেনা। পরবর্তীতে অবশ্য এই বিষয়গুলিকেই দর্শক জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন বলে মনে করা হয়।
উইলিয়াম হ্যানা আর জোসেফ বারবারার (১৯৪০-১৯৫৮) পরে আরো অনেকেই টম এন্ড জেরি নির্মানে কাজ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জেন ডিচ (১৯৬১-১৯৬২), চাক জোন্স (Chuck Jones) (১৯৬৩-১৯৬৭), উইলিয়াম হ্যানা আর জোসেফ বারবারা দ্বিতীয়বারের মত (১৯৭৫-১৯৭৭), টেড টার্নার (Ted Turner) ১৯৮৬, উইলিয়াম হ্যানা আর জোসেফ বারবারা তৃতীয়বারের মত (১৯৯০-১৯৯৪), এবং ওয়ার্নার ব্রোস (Warner Bros.) (২০০৬-২০০৮)। এরপর কার্টূন নেটওয়ার্ক আর ওয়ার্নার ব্রোস সম্মিলিতভাবে ২০১৪ সালে নতুন টম এন্ড জেরি সিরিজ তৈরীর ঘোষনা দেন।
টম এন্ড জেরির এমন ধারাবাহিকতাই বলে দেয় এ জুটি আজীবন সারা বিশ্বজুরে মানুষের হৃদয়ে গেথে থাকবে।
Featured image source: sharemania.us