“বিজ্ঞান বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা বিভিন্ন ভাবে দিলেও মানুষের কাছে এসব ব্যাখ্যার চেয়ে বারমুডার অতিপ্রাকৃত রহস্যময় চরিত্রই যেন বেশী আবেদনময়ী।”
৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৫। ফ্লোরিডার ফোর্ট লেডরডেল ঘাঁটি থেকে ফ্লাইট ১৯ এর পাঁচটি অ্যাভেঞ্জার বম্বার আটলান্টিক মহাসাগরের আকাশে উড়ে দুই ঘন্টার ৫০০ কিলোমিটার উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের জন্য। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই ঘাঁটির সাথে রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৪ জন ক্রু সহ উধাও হয়ে যায় বিমান পাঁচটি। ঐদিন রাতেই উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য একটি ইউ এস মেরিনার সি-প্লেন পাঠানো হলে ১৩ জন ক্রু নিয়ে সেটিও একই পরিণতি বরণ করে।

১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি ইউ এস কোস্টগার্ড উদ্ধার করে দুই দিন আগে নিখোঁজ হওয়া জাহাজ ক্যারল এ ডিয়ারিং। জাহাজটি অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি এর কোন ক্রু বা নাবিক। পাওয়া যায়নি জাহাজের কাগজ পত্র, ক্রনোমিটার, অন্যান্য যন্ত্রপাতি এমনকি ঘড়িও। তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায় কাছাকাছি সময়ে আরও নয়টি জাহাজ একই এলাকায় নিখোঁজ হওয়ার খবর।

বলছি রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর কথা। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমাংশে মিয়ামি, সান জুয়ান, পুয়ের্তো রিকো ও বারমুডা পরিবেষ্টিত ২৫°উত্তর ও ৭১° পশ্চিম অক্ষাংশে অবস্থিত জলসীমা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে পরিচিত। সুদীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দী সময় ধরে চলে আসছে এই এলাকা নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ। এই এলাকায় নিখোঁজ হয়েছে অগণিত নৌযান এবং বিমান। যদিও অনেকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এই ঘটনাগুলোর স্বাভাবিকতা। অনেকেই তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলেছেন যে অত্যন্ত ব্যস্ত নৌ ও আকাশপথ হওয়ায় যে পরিমাণ নৌযান ও বিমান এই অঞ্চল দিয়ে চলাচল করে সে তুলনায় এখানে ঘটা দুর্ঘটনাগুলোর সংখ্যা অন্য যেকোন অঞ্চলের তুলনায় স্বাভাবিক। কিন্তু শত প্রচেষ্টার পরেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গল তার রহস্য নিয়ে স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। এর কারণ হতে পারে এখানে সংঘটিত দুর্ঘটনা গুলোর সাথে জড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিকতা।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে জাহাজ ও বিমানের কম্পাস অস্বাভাবিক আচরণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফ্লাইট ১৯ এর রেডিও রেকর্ড সমূহ থেকে জানা যায় যে পাইলট দিকভ্রান্ত হয়েছিল। একই অভিযোগ পাওয়া গেছে আরও অনেকের ক্ষেত্রে যার অন্যতম হলেন বিখ্যাত নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস। ১৯৬২ সালে এই এলাকা অতিক্রম করার সময় তার কম্পাস দিক নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়।
এইসব রহস্যময় ঘটনা ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে বহুজন বহু তথ্য দিয়েছেন। গল্প হিসেবে প্রচলিত আছে আটলান্টিস নামের এক শহর এখানে তলিয়ে যাওয়ার কথা, যে শহরের অভিশাপ এইসমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী। কেউ কেউ দায়ী করেন ভিন গ্রহের প্রাণী বা এলিয়েন দের। ফ্লাইট ১৯ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ একটি সিনেমা বানিয়েছেন Close Encounters of the Third kind নামে। এই সিনেমায় তিনি দেখিয়েছেন ফ্লাইট ১৯ এর ক্রুদের ধরে নিয়ে গেছে এলিয়েনরা যেখানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল ব্যবহৃত হয়েছে দুই গ্রহের একটি ট্রানজিট হিসেবে।

আরও বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা হিসেবে আছে এক অজ্ঞাত ঝড়ের কথা যা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার মত সময় এবং স্থানের অস্বাভাবিকতা তৈরি করার মত তীব্র বেগ সৃষ্টি করে যা কোন বস্তুকে তার সময় এবং স্থান থেকে অনেক আগে বা পরে সরিয়ে দেয়। ১৯৭০ সালে ব্রুস জেনন নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন তিনি এরকম এক ঝড়ের কবলে পড়ে তার সময় ও অবস্থান থেকে ৩০ মিনিট ও ১৬০ কিলোমিটার অগ্রবর্তী হয়ে গিয়েছিলেন।
কেউ কেউ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের সমুদ্রের তলদেশে সঞ্চিত থাকা বিপুল পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট এইসমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে পানিতে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস থাকলে তা পানির ঘনত্ব কমিয়ে দেয় যা জাহাজ ডুবে যাবার কারণ হতে পারে। এই গ্যাসের আধিক্যের কারণে বিস্ফোরিত হতে পারে বিমানও।

১৯১৮ সালে ইউএসএস সাইক্লপস নামে একটি জাহাজ ৩০৯ জন নাবিক ও প্রচুর ম্যাঙ্গানিজ আকরিক সহ নিখোঁজ হয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রোটিয়াস ও নেরিয়াস নামে দুটি ধাতব আকরিক বোঝাই জাহাজও একই পরিণতি বরণ করে। এর কারণ হিসেবে কেউ দায়ী করেছেন জাহাজ গুলোর এত অধিক ভারবহনের অনুপযোগী ডিজাইনকে, কেউ অনুমান করেছেন সমুদ্রের তলদেশে বিরাট চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতি।

বিজ্ঞান বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা বিভিন্ন ভাবে দিলেও এমন কোন তত্ত্ব দিতে পারেনি যা ঘটনাপ্রবাহ কে যুগপৎ ব্যাখ্যা করে। মানুষের কাছে এসব ব্যাখ্যার চেয়ে বারমুডার অতিপ্রাকৃত রহস্যময় চরিত্রই বেশী আবেদনময়। তাই তো ল্যারি কুশের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্বলিত বই The Bermuda Triangle Mystery: Solved হালে পানি না পেলেও বিভিন্ন রহস্যময় ঘটনা ও অতীত কিংবদন্তি নিয়ে লেখা চার্লস বারলিৎজ এর The Bermuda Triangle বইটি অনূদিত হয়েছে বিশ্বের ত্রিশটি ভাষায়, বিক্রি হয়েছে ২০ মিলিয়নেরও অধিক কপি।
তবে মানুষ মানুক আর নাই মানুক উত্তরাধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা কোনভাবেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অতিপ্রাকৃত রহস্য মেনে নিতে রাজি নন। কার্ল ক্রাজেলনিকি নামে একজন অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞান গবেষক দৃঢ়তার সাথে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যকে নিষ্পত্তি কৃত ঘোষণা করেছেন। তার গবেষণা মতে যেসব জাহাজ ও বিমান বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে নিখোঁজ হয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে তার বেশি সংখ্যকগুলো এই অঞ্চলে আসেইনি বরং সেগুলো ভিন্ন পথের জাহাজ বা বিমান। অন্য যে সকল স্বাভাবিক সংখ্যক জাহাজ বা বিমান এই অঞ্চলে দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছে সেগুলো নেহাৎই দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মন্দ আবহাওয়ার কারণে হয়েছে। এর বাইরে যেসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই অঞ্চলে ঘটেছিল সেগুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও তথ্য উপাত্ত তিনি তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন।

ফ্লাইট ১৯ এর রেডিও ট্রান্সক্রিপ্ট থেকে জানা যায় ফ্লাইটের নেতৃত্ব দানকারী লেফটেন্যান্ট টেইলর এসময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে নয় বরং বাহামাস দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী একটি দ্বীপে অবস্থান করছিলেন। তার বিরুদ্ধে এর আগেও দুইবার বিমান নিয়ে খামখেয়ালি ও নিখোঁজ হবার প্রমাণ রয়েছে। এই দুর্ঘটনাটি পাইলটের ব্যক্তিগত ত্রুটির কারনেই সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। যদি তা নাও হয় তবুও বিমানগুলো নিখোঁজ হয়েছে বাহামাস দ্বীপপুঞ্জ থেকে। আর উদ্ধারের জন্য পাঠানো মেরিনার সি-প্লেন টি বিস্ফোরিত হয়েছিল বলে বেশ কজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে। এই মডেলের বিমানগুলো এই দুর্ঘটনার আগে থেকেই তাদের বিস্ফোরণ প্রবণতার কারণে “উড়ন্ত গ্যাস ট্যাংক” নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

আসলে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অবস্থান হচ্ছে ফ্লোরিডা, পোয়ের্তো রিকো এবং বারমুডার মাঝামাঝি।Hexagonal Cloud বা ষড়ভুজী মেঘ নামে একধরণের মেঘের উপস্থিতি দেখা যায় এ এলাকায়, যার কারণে বাতাসের গতিবেগ খুব তীব্র থাকে এবং জাহাজ বা বিমান সে বাতাসের কবলে পড়ে গায়েব হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, ধ্বংসাবশেষ কেন পাওয়া যায় না; এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন গলফ স্ট্রীম নামে একধরণের স্রোতের কারণে এটা হয় যেটা মেক্সিকো উপসাগর থেকে আটলান্টিক এর দিকে প্রবাহিত হয় এবং এ স্রোতে কোন কিছু ভেসে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কারণ এ স্রোতের গতিবেগ স্রোতের চেয়ে অনেক বেশী।অন্য আরেকটা কারণ বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, সেটা হলো পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চ, যেটা আটলান্টিকের গভীরতম খাদ এবং বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকাতেই পড়ে।এর গভীরতা প্রায় ৮৬৫০ মিটার! সুতরাং, এত গভীর খাদে কোন জিনিস পড়লে তার হদিস না পাওয়া খুব স্বাভাবিক।

অতি সম্প্রতি কার্ল ক্রুসজেলনিকি নামে এক অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী বলেছেন, অন্যান্য মহাসাগরীয় রুট গুলো পর্যালোচনা ও তুলনা করলে দেখা যায় যে, এখানে যে রকম অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা ঘটছে তা অন্য অনেক জায়গাতেই প্রায় একই হারেই ঘটছে। তিনি এমনকি এটাও বলেছেন যে, ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর যেটা হয়েছিল তার জন্য খারাপ আবহাওয়া দায়ী! কারণ সে দিন সমুদ্রের ঢেউ এর উচ্চতা ছিল ৫০ ফুটের কাছাকাছি এবং বাতাসের গতিবেগও ছিল বেশী।

এভাবে ঘটনাগুলো যদি একের পর এক পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে মোটামুটি এই সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে, খারাপ আবহাওয়া ও মনুষ্যসৃষ্ট ভুলই এসব ঘটনার মুল কারণ।তাছাড়া কম্পাস কাজ না করার বিষয়টিও মনগড়া বলে যুক্তি দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আমেরিকান কোস্টগার্ড বা লয়েড’স অব লন্ডন তারাও এ বিষয়ের সাথে একমত হয়েছেন।
আর বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে কম্পাস কাজ করেনা এটি সঠিক নয়; মাঝেমধ্যে বরং দিক নির্দেশনায় বিচ্যুতি দেখা দেয়। আর তখনই হয়ত মানুষ ভুলটা করে বসে। ভৌগোলিকভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অন্য আর দশটা প্রবাহপথ থেকে আলাদা সত্যি,কিন্তু যে সব কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সেগুলোকে গালগল্প বলেই বিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছেন।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল খুব সম্ভবত নেগেটিভ মার্কেটিং বা ব্যাড ওয়ার্ড অব মাউথের শিকার ( Word of Mouth)। আর লেখক বা ফ্যান্টাসি রাইটারদের হাত ধরে এটি অতিরঞ্জনের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকেরা বারমুডা নিয়ে লিখেছেন; তবে মজার ব্যাপার কাছ থেকে দেখে খুব কম মানুষই লিখেছেন। অধিকাংশ লেখকই অন্য একজন লেখকের লেখাকে রেফারেন্স করে লিখেছেন; আর মনের মাধুরী মিশিয়ে দেয়ার ব্যাপার তো আছেই। আর বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের অতিপ্রাকৃত রহস্যময় ঘটনা সমূহের অধিকাংশই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খারাপ আবহাওয়া বা স্বাভাবিক কারনে সংঘটিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষের কল্পনা প্রসূত অপলাপ।
আরো মজার ব্যাপার হলো- ঘোলা পানিতে অনেকেই মাছ শিকার করেন। কিছু জাহাজ কোম্পানী এ সুযোগে তাদের পুরানো ও অকেজো জাহাজগুলোকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে ইচ্ছে করেই নাকি ডুবিয়ে দিয়েছেন বীমা কোম্পানীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য!তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যায় না।

বর্তমান বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে যেখানে সমুদ্রের তলদেশ থেকে মঙ্গল গ্রহের মাটির রহস্য পর্যন্ত মানুষের নখদর্পণে সেখানে অতিপ্রাকৃতিক কাহিনীর চাইতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। তবে আশার কথা, প্রতিনিয়ত গবেষণা ও বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় মানুষ এখন এসব মিথ থেকে বেরিয়ে আসছেন। একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এখন ব্যস্ত একটা নৌ-পথ।
Featured image source: WALLPAPERS HD