১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারি। ইংল্যান্ডের উৎসুক দর্শক কৌতুহল নিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছে, টেলিভিশনের পর্দায় তখন দেখাচ্ছে লন্ডনের নির্জন একটি রাস্তা, সে রাস্তায় আকাশ থেকে অদ্ভুত এক আলোর সাথে একটা লোক এসে পড়ল! হ্যাঙলা গড়নের লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, লোকটির গায়ে বাদামী রঙের টুইড স্যূট প্যান্ট আর লাল টাই! শুধু ইংল্যান্ডবাসিই নয়, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ এই দৃশ্যের সাথে পরিচিত। যে দৃশ্যের মাধ্যমেই আমরা পরিচিত হই খ্যাতিমান মজার আর আমাদের প্রিয় একটি চরিত্র ‘মি. বিন’ এর সাথে!
এই চরিত্রটি এত বেশিই সুপরিচিত যে ‘মি. বিন’ দেখেনি অথবা এর নাম শোনেনি এমন মানুষ পৃধিবীতে কমই আছে। আমাদের বেশিরভাগই আমরা ‘মি. বিন’ এর নানান বাচ্চামি, তার বোকা-সোকা উপস্থিত বুদ্ধি আর আবিষ্কার, তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি এবং তার প্রতিদিনের একের পর এক অদ্ভুত সব কর্মকান্ড দেখে হাসতে হাসতে বড় হয়েছি! ছোট ছোট দোষ-গুন দিয়ে সাজানো হাসি-খুশি এবং মজাদার, সকলের অত্যন্ত প্রিয় ‘মি. বিন’ কে নিয়েই আজকের এই লেখা।

‘মি. বিন’ মূলত কমেডি ধারার ১৪ পর্বের একটি ব্রিটিশ ধারাবাহিক টিভি অনুষ্ঠান যেটি ‘মি. বিন’ নামের একটি চরিত্রের প্রতিদিনের কার্যকলাপ নিয়ে নির্মিত। অনুষ্ঠানটি ১লা জানুয়ারি ১৯৯০ থেকে শুরু করে ৩১শে অক্টোবর ১৯৯৫ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের টিভি প্রোডাকশন ‘আইটিভি’তে সম্প্রচার করা হয়। এই সময়ের মধ্যেই ‘ট্রাবল উইথ মি. বিন’, ‘মেরি ক্রিসমাস মি. বিন’, ‘হেয়ার বাই মি. বিন অফ লন্ডন’ ‘এট দি হসপিটাল’ সহ আরো কয়েকটি পর্ব ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে দর্শক মনে জায়গা করে নেয়!
অনুষ্ঠানের এই পর্বগুলো অন্ত্যত ২০০টি দেশে বিক্রি করা হয়, বানানো হয় আরো কয়েকটি বিশেষ ছোট পর্ব, এনিম্যাটেড কার্টুন সিরিজ সহ দুটি ফিচার চলচ্চিত্র! ধারাবাহিক আর অসামান্য সাফল্য দিয়ে জিতে নেয় ইন্টারন্যাশনাল এমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন রোজ অফ মনট্রেক্স সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরষ্কার।

টিভিতে মি. বিন চরিত্রে আমরা একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক লোককে দেখেত পেলেও তার আচার-আচড়ন কিন্তু পুরোপুরিই শিশুসুলভ! পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল আর সবসময় বাদামী রঙের টুইড স্যুট-প্যান্ট পরে থাকা এই মানুষটিকে প্রতিনিয়তই তার ছোট কৌতুহলী বাচ্চাদের মত করতে থাকা কার্যকলাপের জন্য কোন না কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পরতে হয়। এরপর উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত বিন নিজে নিজেই খেলাচ্ছলে এসব ঝামেলা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে আর এ নিয়েই বেধে যায় যত গোলমাল!
কোন প্রস্তুতি ছাড়াই পরিক্ষার হলে গিয়ে পাশের জনের সাথে ঝামেলা বাধানো, বিমানে চড়ে ১০-১২ বছরের এক ছেলেকে বিরক্ত করতে গিয়ে শেষে নিজেই নাস্তানাবুদ হয়ে পরা, ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে গোলমাল করা, সেলুনে গিয়ে নিছক মজা করতে গিয়ে অন্যজনের শখের চুল কেটে ফেলা সহ ইত্যাদিই ছিল তার প্রতিদিনের কাজ। যে কাজ গুলো তার করা উচিৎ না, সে কাজ গুলোই সে বেছে বেছে করবে। যদিও এসব বোকাসোকা কার্যকলাপের জন্যই বিন আমাদের সবার এত প্রিয়। নিখুত অভিনয় আর অসাধারন দক্ষ পরিচালনায় নির্মিত এসব দেখতে দেখতেই দর্শক হাড়িয়ে যেত কৌতুকপূর্ণ, নির্ভেজাল আনন্দ আর উত্তেজনার মিশেলে তৈরী সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে যা এক কথায় দারুন উপভোগ্য।

মি. বিন এর বাসা বলতে ছিল দুই অথবা এক রুমের ছোট একটি ফ্ল্যাট। সাথে থাকত তার অসম্ভব প্রিয় সঙ্গী চকলেট রঙের টেডি পুতুল, আপনমনেই সে টেডির সাথে খেলে, কথা বলে। একটি লেমন রঙা মিনি গাড়িও ছিল যাতে সে ঘুড়েবেড়াতে ভালোবাসত। এছাড়াও মি. বিন এর একজন বান্ধবী ছিল, নাম ইরমা গব। প্রায়ই তাদের দুইজনের মনোমালিন্য লেগেই থাকত, এসবের পিছনের কারণও মি. বিন এর সেই শিশুসুলভ আচরণ। এছাড়াও ঘনিষ্ঠতা ও রোমান্স নিয়ে বিন বরাবরই ছিল বেরসিক।
সিরিজের প্রতিটি পর্বেই বিন কোন কথা বলেনা বললেই চলে, যদিও ভিজ্যুয়াল হিউমার এই সিটকমের মূল শক্তি! তবে মাঝেমধ্যে মুখ দিয়ে সে কিছু শব্দ করত আর নিজের পরিচয় দিত এভাবে, “বিন! মি. বিন!” এসবও তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গির মতই মজাদার ছিল যা দর্শকদের হাসির উদ্রেক করত। মি. বিন এর এমন অদ্ভুত আচরণ আর কার্যকলাপের জন্য মি. বিনকে বরাবরই আমার কাছে পৃথিবীর বাইরে থেকে আগত মনে হয়েছে।
ইন্ট্রো দৃশ্যে তার আকাশ থেকে পড়া অথবা তার সামনে টিভির অচল হয়ে যাওয়া আমার এ ধারনাকে আরো প্রবল করে! এ কারনেই হয়তো তার আশেপাশের পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করাটা কঠিন হয়ে পরে, নিজেকে স্বাভাবিক আর সবার সাথে সহজে মিশে যাওয়ার জন্যই বিন পড়াশোনা করে, সুইমিং এ যায়, ক্রিসমাস পালন করে বা নিয়মিত গির্জায় যায় কিন্তু এসব করতে গিয়েই আসে যত বিপত্তি।

আচ্ছা, মি. বিন কে তো আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই চিনি। কিন্তু অসাধারন প্রতিভা আর দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তোলা এই চরিত্রের পিছনের মানুষটাকে কি আমরা চিনি? ব্যাক্তি হিসেবে কতটুকুই বা তার জানি? এবার চলুন অসাধারন এই চরিত্রের পিছনে লুকিয়ে থাকা অসাধারন আরেকটি মানুষকে নিয়ে কিছু তথ্য জেনে আসা যাক।

মি. বিন এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো সিরিজ, ছোট পর্ব এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার সব কটিতেই ধারাবাহিক এবং সম্পুর্ন অপরিবর্তিত থেকে অভিনয় করে গেছেন ব্রিটিশ অভিনেতা ও লেখক ‘রোয়ান অ্যাটকিনসন’! অসামান্য প্রতিভাবান এই অভিনেতার পুরো নাম ‘রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন’ আর ডাকনাম ‘রো’। তিনি ব্রিটিশ তালিকাভুক্ত অন্যতম কমেডিয়ানদের মধ্যে একজন! মি. বিন ছাড়াও তিনি ‘ব্ল্যাকাডার’ ও ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক নিউস’ নামে দুটি কমেডি স্কেচ শো এবং হলিউড অ্যাকশন কমেডি ‘জনি ইংলিশ’ এর জন্যও সুপরিচিত। তিনি ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক’ এ দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য ১৯৮১ সালে BAFTA’র Best Entertainment Performance পুরষ্কার জিতেন।
তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজ গুলোর মধ্যে আছে ১৯৮৩ সালের জেমস বন্ড সিরিজের ‘নেভার সে নেভার এগেইন’। এই সিনেমাতে একটি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন রো। ১৯৯৪ সালে অভিনয় করেন ‘ফোর ওয়েডিং এন্ড এ ফুনেরাল’ সিনেমাতে, একই সালে ভয়েস দেন ‘লায়ন কিং’ এ। ২০০৩ সালে একজন জুইয়েলারি বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করেন ‘লাভ একচুয়েলি’ সিনেমাতে। থিয়েটারে অসাধারন অভিনয় করার জন্য ১৯৮১ সালে জিতেন অলিভার অ্যাওয়ার্ড। মি. বিন এর দুটি চলচ্চিত্র আর ইংলিশ ফিল্ম সিরিজ জনি ইংলিশ (২০০৩-২০১৮) দিয়েও তিনি সিনেমাটিক সাফল্য অর্জন করে নেন।

তুঙ্গ-স্পর্শী জনপ্রিয় অ্যাটকিনসন ইংল্যান্ড এর কনসেট, কাউন্টি ডারহামে ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহন করেন। মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে চার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন অ্যাটকিনসন। তার বাবার নাম ছিল এরিক অ্যাটকিনসন যিনি পেশায় একজন কৃষক ছিলেন, এছাড়াও তিনি ছোট একটি কোম্পানির দেখাশোনা করতেন আর মায়ের নাম ছিল এলা মে। তার তিন ভাইয়ের এক ভাই ‘পল’ খুব ছোট থাকতেই মারা যায়, ‘রোডনী’ একজন অর্থনিতীবিদ এবং অন্যজনের নাম ‘রুপার্ট’।
অভিনয় ছাড়াও অ্যাটকিনসন এর আরো কিছু গুনাবলি রয়েছে।
অ্যাটকিনসন পড়াশোনায়ও ছিলেন দারুন মেধাবী ও প্রচন্ড পরিশ্রমী! তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন ডানহ্যামের কোরিষ্টার্স স্কুলে, এরপর সেখান থেকে যান সেন্ট বিস স্কুলে। নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৫ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি নেন এবং একই বিষয়ে কুইন্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ২০০৬ সালে সম্মানজনক ফেলো ডিগ্রী অর্জন করেন।
টিভি অনুষ্ঠান আর চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে মানুষের মন জয় করলেও অ্যাটকিনসন শুরুর দিকে কিন্তু লেখালেখি করেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার লেখা কমেডি ধারার দুটি বই ‘নট দ্য নাইট’ ও ‘ক্লক নিউজ’ দিয়ে ১৯৭৯ এর দিকে বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পান এবং ব্রিটিশ একাডেমি. থেকে জিতে নেন বেশ কিছু পুরষ্কার। পরবর্তিতে এই বইগুলো থেকে টিভি কমিক অনুষ্ঠান নির্মান করা হয় যাতে অভিনয় করেছিলেন তিনি নিজেই।

ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের দিকে অ্যাটকিনসনের একটা ঝোক ছিল। তার স্কুল ক্যাথেড্রালে তখন একটি ফিল্ম সোসাইটি ছিল, সে ফিল্ম সোসাইটিতে শিশুতোষ আর মজার বিভিন্ন সিনেমা দেখানো হত। বাসায় তখন তাদের টিভি ছিলনা, ফিল্ম সোসাইটির সেসব সিনেমাই দেখতে দেখতেই তার অভিনয়ের দিয়ে আগ্রহ তৈরী হয়। নিজে নিজেই তিনি সিনেমার চরিত্রগুলোকে অনুসরন করতেন। এরপর তিনি থিয়েটারের ব্যাক-স্টেজে কাজ করা শুরু করেন। প্রবল আগ্রহ থাকলেও নিজের শারীরিক গঠন আর তোতলামির থাকার জন্য অবহেলিতও হতে হয় তাকে, বেশ কিছু সুযোগও হাতছাড়া হয়। কিন্তু পরবর্তিতে এসব কিছুকে ছাপিয়েই অদম্য অ্যাটকিনসন নিজেকে প্রমান করেন!
মানুষ হাসানো রূপালী পর্দার এই কারিগরকে সবাই তার চরিত্রের মতই চঞ্চল মনে করলেও ব্যাক্তি জীবনে সে চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। কম কথা বলতেই তিনি পছন্দ করেন। ১৯৯০ সালে মেকআপ আর্টিস্ট সূনেত্রা শাস্ত্রীকে বিয়ে করেন। তাদের লিলি এবং বেনজামিন নামের দুটি সন্তান রয়েছে। ২০১২ সালে পঞ্চাশোর্ধ অ্যাটকিনসন মি. বিন থেকে অবসরের ঘোষনা দেন। বিবিসি থেকে সেরা ব্যাক্তিত্বের পুরস্কার পাওয়া কিংবদন্তী এই অভিনেতা বর্তমানে সর্বকালের সেরা সেলিব্রেটিদের একজন!
Featured image source: goodyfeed.com