গত পর্বে আমরা সমূদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো ৫টি বিখ্যাত ভৌতিক জাহাজের গল্প আপনাদের বলেছি। আমাদের আজকের পর্বে আমরা আরো কিছু রহস্যময় জাহাজের কথা আপনাদের বলবো যার রহস্য এখনো কেউ সমাধান করতে পারেনি। প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে – সমূদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো কিছু ভৌতিক জাহাজ (১ম পর্ব)
অক্টাভিয়াস
গ্রীণল্যান্ডের সমূদ্র উপকূলে তিমি শিকারী জাহাজ হেরাল্ড (Herald) ১লা অক্টোবর ১৭৭৫ সালে হঠাৎ একটি জনমানবহীন জাহাজের সন্ধান পায়। অক্টাভিয়াস (Octavius) নামের জনমানবহীন এ জাহাজটিতে যখন হেরাল্ড এর কর্মীরা প্রবেশ করেন তখন জাহজের ভেতরে বরফে জমে যাওয়া ২৮ জন নাবিকের মৃতদেহ দেখতে পান। পরিস্থিতি আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে যখন তারা জাহাজটির ক্যাপ্টেনের কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে জাহাজের লগবুক খোলা অবস্থায় একটি কলম হাতে ক্যাপ্টেনকে মৃত অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। তার ঠিক পাশেই চাদরে আবৃত একজন নারী সহ একটি শিশুর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়।
লগবুকে সর্বশেষ ১৭৬২ সালের তথ্য পাওয়া যায়, অর্থাৎ দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে হয়ত জাহাজটি এভাবেই ভেসে চলেছিল আর্কটিক সাগরের বুকে। নাবিকরা যখন জাহাটিকে সেখানে রেখে উপকূলে ফিরে আসেন এবং জাহাজটি কথা অন্যান্যদের কে জানান রহস্যময় অক্টাভিয়াসের উদ্দেশ্যে তখন অনেকেই যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই জাহাজটি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। আজও পর্যন্ত জাহাজটির কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। অক্টাভিয়াস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন উপন্যাস থেকে শুরু করে ভিডিও গেমস।

জয়িতা
১৯৯৫ সালে মাছ ধরা ছোট জাহাজ জয়িতা (MV Joyita) দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পূর্বে সমূদ্রে মাছ ধরতে যাবার পর জরুরী সাহায্য চেয়ে বেতার সংকেত প্রেরণ করে জাহাজটি হঠাৎ হারিয়ে যায়। জাহজটিকে খুঁজে বের করতে পরবর্তীতে আকাশ এবং জলপথে উদ্ধার অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু অনুসন্ধানকারীরা কোন রকম হদিস খুঁজে বের করতে পারেন নি।
এ ঘটনার প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর একটি বাণিজ্য জাহাজ সমূদ্রে কোন রকমে ভেসে থাকা অবস্থায় জাহাজটিকে খুঁজে পান। যে জায়গাটি থেকে বেতার সংকেত পাঠিয়েছিল তার থেকে প্রায় ৬০০ মাইল দুরে জাহাজটিকে উদ্ধার করা হয়। জাহাজটিতে যখন প্রবেশ করা হয় তখনও অস্ত্রপচারের বিভিন্ন সরঞ্জাম সহ একটি ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যদিকে সমগ্র জাহাজে রক্তমাখা ব্যান্ডেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তবে জাহাজটি থেকে কোন মৃতদেহ বা জাহাজের নাবিকদের কোন হদিস মেলেনি। রক্তমাখা ব্যান্ডেজ গুলো সহ নাবিকদের সাথে ঠিক কি ঘটেছিল তা আজও রহস্য হয়ে আছে।

লেডি লভিবন্ড
লেডি লভিবন্ড (Lady Lovibond) জাহজটিকে ভালোবাসা, হিংসা এবং ক্রোধের মিশেলে এক অভূতপূর্ব রহস্য বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। ১৭৪৮ সালের ভ্যালেন্টাইনে ডে (Valentine Day) এর আগের দিন জাহাজটি সমূদ্রের বুকে আনন্দে মেতে উঠেছিল জাহাজের ক্যাপ্টেন সাইমন রিড (Simon Reed) এর বিয়ের উৎসবকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আড়াল থেকে সে জাহাজেই ক্যাপ্টেন এর কাছের একজন বন্ধু ও সহকর্মী জন রিভার্স (John Rivers) তখন ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠেন। ক্যাপ্টেন এর হবু স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা থেকে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। ফলে ক্যাপ্টেনের বিবাহ উৎসবে সবাই আনন্দে মেতে উঠলেও তিনি জ্বলতে থাকেন প্রতিহিংসার আগুনে।
জন রিভার্স জাহাজটির গতিপথ বদলে কেন্ট (Kent) উপকূলের গুডউইন্ড স্যান্ড (Goodwind Sand) নামের একটি স্থানে ডুবিয়ে দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কেওই প্রাণ বাঁচানোর মত পদক্ষেপ নিতে পারেন নি। ফলে জাহাজে থাকা প্রত্যেকেই সমূদ্রে ডুবে মারা যান। এর পরবর্তীতে ১৭৯৮, ১৮৪৮, ১৮৯৮, ১৯৪৮ সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে অর্থাৎ প্রত্যেক ৫০ বছর পর পর বিধ্বস্থ অবস্থায় জাহাজটিকে ভেসে থাকতে দেখা যায়। এরমধ্যে কয়েকবার জাহাজটিকে দেখতে পেয়ে কাছে থাকা জাহাজগুলি উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই কয়েক মুহূর্তের উপস্থিতির পর জাহাজটি নিজ থেকেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।

ম্যারি চেলেস্ট
জাহাজ থেকে নাবিকদের উধাও হয়ে যাবার মত রহস্যময় ঘটনা অনেকগুলি ভৌতিক জাহাজের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এর মধ্যে অন্যতম ব্যাখ্যাতীতভাবে নাবিকদের হারিয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছিল জাহাজ মেরি চেলেস্ট এর সাথে। ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর কানাডিয়ান জাহাজ দাই গ্রেসিয়া (Dei Gratia) জনশূণ্য অবস্থায় ম্যারি চেলেস্ট (Mary Celeste) জাহাজটিকে আবিস্কার করে। দুই মাস্তুল ওয়ালা জাহাজটি সবগুলো পাল খোলা রেখে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ভেসে বেড়াচ্ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে।
দূর থেকে দেখে সন্দেহ করার মত কোন উপায়ই ছিল না যে জাহাজটিতে কিছু অস্বাভাবিকতা রয়েছে। কানাডিয়ান জাহাজটি খুব কাছ দিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করে জাহাজটি সম্পূর্ণ জনমানবহীন ভাবে ভেসে চলেছে। যখন গ্রেসিয়ার নাবিকেরা ম্যারি চেলেস্টে যেয়ে পৌঁছে তখন তারা আবিস্কার করে জাহাজটিতে প্রায় ১৫০০ ব্যারেল এলকোহল রয়েছে যেগুলো খোলা বা পান করা হয়নি। এমন কি নাবিকদের জিনিসপত্রও অক্ষত অবস্থায় রাখা রয়েছে। জাহাজের সমস্ত জিনিস পত্র সবকিছু এতো স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে যেন একটু আগেও সেখানে নাবিকেরা ছিল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সবগুলো লাইফবোটের সাথে সমগ্র নাবিক থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন কারোরই কোন খোঁজ নেই। অনেক ভেবেও তারা লাইফবোট ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে এমন কোন কারণ বের করতে পারেন নি। কারণ কোন দূর্যোগ বা যান্ত্রিক সমস্যা বা জলদস্যু আক্রমণে চিহ্ন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি জাহাজটিতে। কি কারণে বা কোথায় জাহজটির সকল নাবিকেরা হারিয়ে গেল তা আজও একটি অমীমাংসিত রহস্য হয়ে আছে।

ফ্লাইং ডাচম্যান
ভৌতিক জাহাজের মধ্যে সব থেকে বেশি আলোচিত বা পরিচিত যে জাহাজটি সেটি নি:সন্দেহে ফ্লাইং ডাচম্যান (Flying Dutchman)। সিনেমা উপন্যাস গান এমন কি থিম পার্কেও ফ্লাইং ডাচ ম্যানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
কয়েক শতাব্দী ধরে ফ্লাইং ডাচম্যানকে একটি অভিশপ্ত জাহাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। নাবিকদের বিশ্বাস সমূদ্রে যারাই এর মুখোমুখি হবে তারা কোন না কোন ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়বে। বিগত কয়েক শতকে কয়েকশ নাবিক এই অভিশপ্ত জাহাজের দেখা পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। আসলে জাহাজটিতে ঠিক কি ঘটেছিল কিভাবেই বা জাহাজটি অভিশপ্ত হয়ে উঠল এ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মতবাদ দেখা যায়। তারমধ্যে সবচে আলোচিত হলো জাহাজটির ক্যাপ্টেন ভ্যান ডার ডিকেন (Van der Decken) প্রবল দূর্যোগের মধ্যেও কেপ টাউনে (Cape Town) তার গন্তব্য অভিমুখে যাত্রা অব্যহত রাখেন।
উত্তাল সমূদ্রে কারণে অনকে নাবিক ক্যাপ্টেনকে সমূদ্র যাত্রা স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে সমূদ্র আরো ভয়ঙ্কর হতে থাকে কিন্তু ক্যাপ্টেন তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সমূদ্র পরিস্থিতি এবং নিজেদের আসন্ন বিপদ উপলব্ধি করে নাবিকদের একটি অংশ তখন ক্যাপ্টেনের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহ দমন করতে ক্যাপ্টেন কয়েকজন নাবিককে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেন উত্তাল সমূদ্রে। এ ঘটনার পরপরই প্রবল ঝড়ের মুখে জাহাজটি ক্যাপ্টেন সহ সকল নাবিককে নিয়ে ডুবে যায় গভীর সমূদ্রে।
এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন মতবাদ জাহাজটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। যেমন জাহাজটি প্লেগ রোগী বোঝাই নাবিকে ভর্তি ছিল ফলে কোন বন্দরে জাহাজটিকে নোঙ্গর করতে দেওয়া হয় নি। ধুকে ধুকে জাহাজের নাবিকেরা মারা যায়। মৃত্যুপথযাত্রী নাবিকদের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে ওঠে জাহাজটি এবং পরবর্তীতে প্রতিশোধের নেশায় অনিষ্ট সাধনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় হাজির হয়ে জাহাজটি।

ফ্লাইং ডাচম্যান জাহাজটি কি কারণেই বা অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল বা তার অস্তিত্ব কতট যৌক্তিক সেটি জানা না গেলেও ফ্লাইং ডাচম্যান সহ অন্যান্য ভৌতিক জাহাজগুলো স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে মানুষের মনে। আরো অনেক শতাব্দী ধরে হয়ত রহস্যের ডালপালা বৃদ্ধি করে চলবে এসব ভৌতিক জাহাজগুলো। পাশাপাশি সিনেমা উপন্যাস বা উপকথার জন্য হয়ে উঠবে মূল্যবান খোরাক।
Featured image source: allmacwallpaper.com