অশরীরি, ভৌতিক বা ব্যাখ্যাহীন ঘটনার উপস্থিতি শতাব্দী পেরিয়ে আজও পর্যন্ত আমাদেরকে তাড়া করে চলেছে। এমন অনেক ভৌতিক ঘটনার ব্যাখ্যা হয়ত আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান দিতে পেরেছে কিন্তু তা বাদেও অসংখ্য ঘটনা থেকে গেছে আমাদের আয়ত্তের বাইরে। এসব ব্যাখ্যাহীন ঘটনার দেখা মেলে লোকালয় থেকে শুরু করে জঙ্গল এমনকি সমূদ্রের বুকেও। পরবর্তীতে এগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নানা উপকথা, গল্প, উপন্যাস এমন কি সিনেমাও।
দুই পর্বের লেখায় আমরা পিছু ধাওয়া করবো সমূদ্রের বুকে রহস্যের জন্ম দিয়ে ভেসে বেড়ানো কিছু বিখ্যাত ভৌতিক জাহাজের পিছনে। আজ প্রথম পর্ব।
ক্যালিউচ
ভৌতিক জাহাজের কথা বললেই যে নাম গুলি সবার প্রথমে মনে আসে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ক্যালিউচ (Caleuche)। চিলির (Chile) পৌরানিক উপকথাগুলিতে প্রথম এই জাহাজটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। চিলি উপকূলের চিলয় (Chiloé) নামের ছোট্ট দ্বীপের বাসিন্দা ও তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো জাহাজগুলি ভৌতিক জাহাজ ক্যালিউচের দেখা পেয়েছেন বলে দাবী করেন।
তাদের দাবী অনুযায়ী রহস্যময় এ জাহাজটি প্রায় রাতে কিছু সময়ের জন্য দৃশ্যমান হয়। এ সময় জাহাজটি থেকে অট্টহাসি, হৈ-হুল্লোড় এবং বাদ্যের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। সমগ্র জাহাজ থেকে শুরু করে মাস্তুল পর্যন্ত আলো ঝলমল করতে থাকে। অত:পর যেমন হঠাৎ করে জাহাজটির আবির্ভাব হয় কয়েক মুহূর্ত পর তেমনি হঠাৎ করে উপস্থিতির কোন চিহ্ন না রেখেই জাহাজটি উধাও হয়ে যায় সমূদ্রের বুকে।

এস এস ভ্যালেন্সিয়া
এস এস ভ্যালেন্সিয়া (SS Valencia) ১৯৮২ সালের তৈরি হওয়া একটি ছোট স্টিমার (steamer) যেটি নিউ ইয়র্ক থেকে ভেনিজুয়েলা (Venezuela) সমূদ্র পথে যাত্রী পরিসেবা প্রদান করত। ১৯০৬ সালে স্টিমারটি প্রায় ১০৮ জন যাত্রী নিয়ে তার যাত্রাকালে ভয়াবহ সামূদ্রীক দূর্যোগের মুখে পড়ে সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যায় ভ্যানকুভার (Vancouver) সমূদ্র উপকূলে। যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাতে স্টিমারের লাইফ বোট গুলোকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রায় ৩৭ জন যাত্রী লাইফ বোটের সহায়তায় প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হন। কিন্তু রহস্যময়ভাবে একটি লাইফবোট হারিয়ে যায় সমূদ্রে যার সন্ধান আজও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এ দূর্ঘটনার পর এস এস ভ্যালেন্সিয়া স্টিমারটিকে কেন্দ্র করে নানা ভৌতিক গল্প কাহিনী গড়ে উঠতে থাকে। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভ্যানকুভার দ্বীপের জেলে ও বাসিন্দাদের দাবী মতে তারা অনেকেই ডুবে যাওয়া স্টিমারটিকে সমূদ্র্ উপকূলে ভেসে বেড়াতে দেখেছেন। তাদের মতে যতবারই স্ট্রিমারটিকে দেখা গিয়েছে প্রত্যেকবারই তা কঙ্কালে ভর্তি ছিল যেন কঙ্কাল যাত্রীদের নিয়ে জাহাজটি ভেসে চলেছে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

ওরং মেডান
১৯৪৭ সালে মালাক্কা প্রণালীর অতিক্রম করার সময় দুটি আমেরিকান জাহাজের রেডিওতে কাছেই থাকা ওরং মেডন (Ourang Medan) নামের একটি জাহজ থেকে জরুরী সাহায্য চেয়ে একটি বেতার বার্তা ধরা পড়ে। বেতার বার্তাটিতে বলা হচ্ছে তার জাহাজের সবাই মারা গিয়েছে। এবং বার্তাটি শেষ হয়েছে ”আমিও মারা যাচ্ছি” এমন অদ্ভুত বাক্য দিয়ে। বেতার বার্তাটি পাবার সাথে সাথে আমেরিকান জাহাজ দুটি ওরং মেডানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
কিন্তু তারা যখন জাহাজটির কাছে পৌঁছে তখন দেখা যায় জাহজটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আছে্। কোন দূর্ঘটনা বা অস্বভাবিক কিছু তাদের চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু যখন জাহাজে প্রবেশ করা হয় তখন দেখা যায় চারিদিকে পড়ে আছে মৃতদেহ এবং জাহাজের সবাই মারা গিয়েছে। এমনকি জাহাজটিতে থাকা কুকুরটিও মরে পড়ে আছে। প্রত্যেকটি মৃতদেহের মুখে ফুটে আছে বিকৃত অভিব্যক্তি যেন তাদের শেষ সময়টি গিয়েছিল প্রচন্ড ভয় আর যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে। পরবর্তীতে বিস্তারিত অনুসন্ধানের পূর্বেই জাহাজটি আগুন লেগে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। ফলে সেদিন হতভাগ্য নাবিকদের সাথে ঠিক কি হয়েছিল তা আজও অজানা থেকে গেছে।

ক্যারল এ. ডিয়ারিং
ভৌতিক জাহাজ রহস্যময় সমূদ্র নিয়ে কথা বলতে গেলে যে নামটি প্রায় সকলেরই মনে উঁকি দেয় সেটি হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের রহস্যের জালে আটকে পড়া জাহজগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হলো ক্যারল এ ডিয়ারিং জাহাজটি। জাহাজভর্তি কয়লা এবং প্রায় ১০ জন নাবিক নিয়ে জাহাজটি নর্থ ক্যারোলিনার (North Carolina) কেপ হ্যাটারস (Cape Hatters) বন্দরের কাছে আটলান্টিকের কবর খানা বলে খ্যাত ডায়মন্ড শোলসের (Diamond Sholes) কাছে আটকে পড়ে।
সাহায্য চেয়ে বেতার বার্তা প্রেরণ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার কার্য্ক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারনে। জাহাজটির কাছে পৌঁছাতে বেশ কয়েকদিন লেগে যায় কোস্ট গার্ড সহ উদ্ধার কর্মীদের। কিন্তু যখন তারা যখন জাহাজটির কাছে পৌঁছান তখন দেখা যায় জাহাজটি অক্ষত অবস্থায়ই আছে। কিন্তু জাহাজের কিছু যন্ত্রপাতি, লগবুক আর দুটি লাইফ-বোটের সাথে জাহাজের সকল নাবিকেরা বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছেন। পরবর্তীতে অনুসন্ধান চালিয়েও জাহাজের হারিয়ে যাওয়া নাবিকদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই সাথে অমীমাংসিত থেকে গেছে ক্যারল এ. ডিয়ারিং এর রহস্যটি।

বেইচিমো
হাডসন বে (Hudson Bay) কোম্পানীর এ জাহাজটি হিম শীতল আলাস্কার সমূদ্র উপকূল ধরে যাতায়াত করত। ১ অক্টোবর ১৯৩১ সালে মাল বোঝাই জাহাজটি হঠাৎ আলাস্কার সমূদ্রে ভেসে বেড়ানো হিম শৈলে আটকে পড়ে। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও যখন সমূদ্রে আবহাওয়ার উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যায় না তখন কোম্পানী বাধ্য হয়ে জাহাজের নাবিকদের সরিয়ে নিয়ে যায় জাহাজটিকে এক প্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে।

মাস ঘুরতে সমূদ্রের আবহাওয়া আরো খারাপ হয়ে যায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন সহ কোম্পানীর সকলে নিশ্চিত হয়ে যান জাহাজটি খারাপ আবহাওয়ার মুখে নিশ্চিতভাবে সমূদ্রে ডুবে গিয়েছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে জাহাজটিকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে খোলা সমূদ্রে একা একা ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। এ ঘটনাটি গণ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পেলে সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়। জাহাজটিকে ছেড়ে আসার বহুবছর পর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে এমন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেসে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল। অনুসন্ধানকারীরা পরবর্তীতে জাহাজটিকে খুঁজে বের করতে ব্যাপক অনুসন্ধান চালালেও জাহাজটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব পড়ুন এখানে – সমূদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো কিছু ভৌতিক জাহাজ (শেষ পর্ব)
Feature Image : editions.lib.umn.edu