পল তিব্বেটস, মেজর সুইনি ও তাঁদের দলবলের রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা আর হিরোশিমা ও নাগাসাকির হতভাগ্য মানুষের গল্পের ইতি টানতেই লেখারপাতার পাঠকদের জন্য আজ এই সিরিজের চতুর্থ এবং শেষ পর্ব ‘নাগাসাকির গল্প-২’। আজকের পর্বের একদম শেষে আছে হিরোশিমা নাগাসাকির বর্তমান অবস্থা।
প্রথম পর্ব ‘হিরোশিমা’র গল্প-১’ ও দ্বিতীয় পর্ব ‘হিরোশিমার গল্প-২’ এ আমরা ঘটনার শুরুর দিকের ও হিরোশিমাতে হামলার বিষয়গুলো এবং তৃতীয় পর্ব ‘নাগাসাকি’র গল্প-১’ এ আমরা নাগাসাকি হামলার পটভূমি আলোচনা করেছি।
হামলার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া
নাগাসাকি ছিল পশ্চিম কিইউশু (Kyushu) উপকূলের একটি শহর। শহরটি ম্যাডাম বাটারফ্লাই এর অপেরা হাউসের জন্য আগে থেকেই বিখ্যাত ছিল। এছাড়াও উরাকামি (Urakami) নদীর পাশে মিৎসুবিশি নামের দুটি বিশাল যুদ্ধ প্ল্যান্ট ছিল যেটিকে পারমাণবিক হামলার মূল লক্ষ হিসেবে ধরা হয়। বক্সকার যখন এখানে এসে পৌছায় পুরো শহরটা তখন মেঘের নিচে ঢাকা ছিল, আর অঞ্চলটা পাহাড়ি হওয়ায় এখানে লক্ষ্যভেদ করাটা মেজর সুইনি ও তার মেম্বারদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে! অপেক্ষার কিছু সময় পরে মেঘ সরতে দেখা যায়, ক্যাপ্টেন কার্মিট কে বিহান সে সুযোগটা নিয়ে নেয়, দীর্ঘ প্রায় ৮ ঘন্টা পরে সকাল ১১:০২ মিনিটে ফ্যাট-ম্যানকে নিচে ছেড়ে দেয়া হয়!
এরপরের ঘটনা হিরোশিমার মতই! প্রচন্ড গতিতে ফ্যাটম্যান নাগাসাকির দিকে নামতে থাকে! মাত্র ৪৩ সেকেন্ড পরেই নাগাসাকির বুকের ১৬৫০ ফুট উপরে প্রচন্ড শব্দে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়! চোখ ধাঁধানো অতি-উজ্জ্বল আলোয় ছেয়ে যায় চারিদিক, ভয়াবহ বিস্ফোরনের ধাক্কায় কেঁপে ওঠে গোটা শহর! প্রায় ৪০,০০০ মানুষ সাথে সাথে মারা যায়। পরবর্তিতে বোমার তেজষ্ক্রিয়তায় ঝলসে যাওয়া ও আহত হওয়া আরো ৩৫,০০০ মানুষ মারা যায়! মিতুমারু উপত্যকা আর মিৎসুবিশি’র যুদ্ধ প্ল্যান্ট দুটিরও বেশ ভালোই ক্ষয়ক্ষতি হয়। বোমাটি যে অঞ্চলে পতিত হয় সে জায়গাটি ধ্বংস হয়ে মাটির সাথে মিশে যায়।

বেঁচে যাওয়া নাগাসাকির এক নাগরিক একটি দৃশ্যের বর্ননা দেন –
“আমার বাড়ির সামনের বিশাল কুমড়া’র ক্ষেতটির একদম কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা, পুরো এলাকাটি একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে মাঠের মত হয়ে আছে। সে মাঠে কুমড়ার বদলে পরে ছিল কিছু মানুষের মাথা! আর তাদের চোখ গুলো বিকিরণের অতি উজ্জ্বল আলোয় ঝলসানো ছিল!”
তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ফ্যাট-ম্যান, আর পাহারি অঞ্চল হওয়ায় ধ্বংস ও হতাহতের সংখ্যা ছিল হিরোশিমার চেয়ে অনেক কম। হিরোশিমার যেখানে প্রায় ৯০% শতাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেখানে ফ্যাট-ম্যান অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ার পরেও নাগাসাকির ধ্বংসের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪০% শতাংশ।
বিস্ফোরনের মাত্র এক মিনিটের মধ্যেই মেজর সুইনি ও তার ক্রু মেম্বাররা দেখল একটি অতিকায় বিশাল ধোয়ার মেঘ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে একই সাথে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরনের শক ওয়েভ বক্সকার ও অন্য আরেকটি বি-২৯ কে ধাক্কা দেয়! এরপর আর দেরি না করে সুইনি ও তার ক্রু’রা নিজেদের ফেরার পথে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
হামলার পরিণাম
ক্ষয়ক্ষতি’র পরিমাণ কম হলেও নাগাসাকির কাছেও এ হামলা দু;স্বপনের মতই ছিল। শহরের ৪০% শতাংশের পুরোটাই ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয় আর এর বেশীরভাগ মানুষই হতাহতের শিকার হয়! বাড়িঘর, স্কুল, রাস্তা ঘাট সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বড় বড় সব হসপিটাল গুলোকে মুখ থুবড়ে পরে থাকতে দেখা যায়, হামলায় আহতরা যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে পঙ্গু হয়ে যেতে শুরু করে আর আক্রান্ত হতে থাকে নানান ধরনের অসুখে!
হিরোশিমা ও নাগাসাকি’তে হামলায় বেঁচে যাওয়া আহতদের বলা হয় ‘হিবাকুশা’ (Hibakusha)। এমনই এক পরিচিত মুখ হিবাকুশা’র নাম – ইয়ামাগুচি। তিনি পর পর দুটি পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে গেলেও মারাত্নক ভাবে আহত হয়েছিলেন। তার শরীর তেজষ্ক্রিয়তায় সংক্রমিত হয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। নিয়মিত ভাবেই তার বমি হত, আস্তে আস্তে কিছুটা সেরে উঠলেও তীব্র কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা এ মানুষটি ২০০৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১০ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন!

১৯৪৫ সালের আগস্টের ওই ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরনের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৫,০০০ মারা যায়, মৃত্যুবরণকারীদের বেশিরভাগই ছিল নিরীহ ও বেসামরিক! দুই শহরেই বোমার তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাবে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরো ২১৪,০০০, বেসরকারি হিসেব মতে এ সংখ্যা প্রায় ৪০০,০০০!
জাপানের প্রতিক্রিয়া ও আত্নসমর্পন
৬ আগস্ট হিরোশিমায় হামলার পরেও আত্নসমর্পনের জন্য জাপানের অবস্থান কিছুটা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিল। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বারবার আত্নসমর্পনের কথা বলে আসলেও জাপান সম্রাট ‘হিরোহিতো’ (Hirohito) আত্নসমর্পনের বিপক্ষে ছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। আত্নসমর্পনের বিপক্ষের অনেকেই ‘আত্নসমর্পনের চেয়ে আত্নহত্যাই শ্রেয়’ মনে করে আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়!
জাপানের যুদ্ধ বিষয়ক কাউন্সিলও অভ্যন্তরীন অবস্থা আর আক্রমনের ধাক্কায় কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলনা। কিন্তু ৯ আগস্ট নাগাসাকির হামলা সব কিছুই সহজ করে দেয়! ১৫ই আগস্ট ১৯৪৫, জাপান সম্রাট হিরোহিতো এক রেডিও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আত্নসমর্পন করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়! এর কিছুদিন পর ২রা সেপ্টেম্বর হিরোহিতো ‘টোকিও বে’তে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্নসমর্পণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।

জাপানের আত্নসমর্পনের পিছনে পারমাণবিক বোমা হামলাকে অনেক বড় ভূমিকা মনে করা হলেও হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মানবতার প্রতি যে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে তা নিয়ে জাপান ও বিশ্বের অনেক দেশেই নানান তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়! অনেকেই মনে করেন পারমাণবিক হামলার অনেক আগেই জাপান কোনঠাসা হয়ে পরেছিল, যেখানে কিছুদিন পরে জাপান হয়তো স্বেচ্ছায়ই আত্নসমর্পন করত সেখানে পারমাণবিক বোমা ছুড়ে দিয়ে নৃশংস উপায়ে মানুষ মারার কোন প্রয়োজনই ছিলনা।
জাপানবাসীও দাবি করেন, জাপানের যুদ্ধ বিষয়ক কাউন্সিলের নেতৃত্বে অনেক আগে থেকেই গোপনে আত্নসমর্পনের জন্য কাজ করা হচ্ছিল, এমনকি ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে বোমা হামলার দিনও কাউন্সিলটি গোপনে বৈঠক করছিলেন! কিন্তু এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রুমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরের অধিকাংশেরই কখনো কোন অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, নিজেদের শক্তিমত্তার প্রদর্শন ও বিশ্ববাসীকে অভাবনীয় কিছু করে দেখানো ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করেন অনেক বিষেশজ্ঞরাই!

হিরোশিমার বর্তমান অবস্থা
পারমানবিক বোমা হামলায় প্রায় নিশ্চিহ্ন ও বোমার তেজষ্ক্রিয়তায় দূষিত হয়ে যাওয়া শহরটিতে এখন ১.১২ মিলিয়ন জনসংখ্যার সমন্বয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় একটি নগর। বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমাকে ১৯৫০ সাল থেকে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয়, হিরোশিমা এখন জাপানের অন্যতম প্রধান শিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত। হিরোশিমার এখন প্রধান শিল্পগুলো হল, স্বয়ংক্রিয় মেশিন, মোটর কোম্পানি মাজদা এবং খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াকরন। মজার বিষয় হচ্ছে, হিরোশিমার এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুতই আসে পারমানবিক শক্তি থেকে। কয়েকদশকের চেষ্টা এখন স্পষ্ট হয়েছে।

আজকের আধুনিক হিরোশিমা শহরে প্রতিদিনই মানুষ স্বাভাবিক ভাবে ঘুড়ে-বেড়াচ্ছে, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, উপাসনালয়, শপিংমল আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ন! সাজানো গোছানো শহরতলীর রাস্তার পাশগুলোতে সারিবদ্ধ সব দালান আর ভবন দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি পার্ক এখন সুন্দর আর সবুজ।
হিরোশিমার যে জায়গাটির উপরে লিটল বয় পড়েছিল, সেখানে এখন ‘পিস মেমোরিয়াল পার্ক’ তৈরী করা হয়েছে যেখানে প্রতি বছরই একটি বার্ষিক শান্তির ঘোষনা পাঠ করা হয় এবং শান্তি সংস্কৃতির শহর হিসেবে পারমানবিক অস্ত্র থেকে মুক্তির একটি বিশ্বসম্মেলন নিয়মিতভাবে হয়ে আসছে। যা হিরোশিমা তথা জাপানবাসী বিশ্বাস করে এই ঘোষনা পরবর্তি প্রজন্মকে শান্তির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করবে!
আমেরিকা কিন্তু শুধু হিরোশিমাতে হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, অকল্পনীয় এক বিস্ফোরনের তান্ডবে জাপান জ্ঞানশূন্য হয়ে পরলেও আমেরিকা কিন্তু তখন অন্যকিছুই ভাবছিল!
নাগাসাকির বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে নাগাসাকি জাপানের একটি ব্যাস্ততম শিল্প নগরী। হিরোশিমার মতই নাগাসাকিও অনেক আগেই ঘুরে দাড়িয়েছে, বর্তমানে এ শহরে প্রায় ৫ লাখ মানুষের বসবাস। নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়ে যাওয়া শহরটাকে পরিশ্রমী জাপানিরা আবারো রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছে। ধ্বংস ও অকেজো হয়ে যাওয়া মিতসুবিশি পাওয়ার প্ল্যান্ট আবারো চালু করা হয়েছে যার উৎপাদিত পাওয়ার প্ল্যান্ট, মোটর সহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র এখন সারা বিশ্বে পরিচিত।

হিরোশিমা ও নাগাসাকি দুটি শহরেই এখন নানান অনুষ্ঠান ও শান্তির বার্তা বিষয়ক কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসকে স্মরন করা হয়, তৈরী করা হয়েছে নানান স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর। নাগাসাকিতেও এমনই এক জাদুঘর নির্মান করা হয়েছে, যেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি এবং পৃথিবিতে শান্তির গুরুত্ব সম্পর্কে সবাইকে অবগত করা হয়। জাপানবাসী তাদের সে ভয়ানক অভিজ্ঞতাকে ভুলে না গিয়ে এভাবেই স্মরন করতে চায় আর প্রার্থনা করে পৃথিবীতে এমন ধ্বংসযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি আর না হয়।

জাপানের এমন চাওয়াকে আমরা সকলেই বুকের ভিতরে ধারন ও সমর্থন করি, উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, বিদ্বেষের মাত্রা যতই আগ্রাসী হোক না কেন, ইতিহাসের নারকীয় সেই পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাবহার ও মৃত্যুর শহর পৃথিবীর কোথাও আমরা আর দেখতে চাইনা!
Featured image source: asahi.com