জাপানের জনগণ যখন হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা হামলার ধাক্কায় দিশেহারা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমানের (U.S President Harry Truman) নির্দেশে দ্বিতীয় বোমা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল!
হিরোশিমা হামলার ঠিক তিনদিন পর ৯ই আগষ্ট জাপানের আরেক শহর ‘নাগাসাকি’তে লিটল বয়ের চেয়েও শক্তিশালী আরেকটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়, যে বোমার আঘাতে প্রায় ৮০,০০০ নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই পর পর দুটি পারমাণবিক বোমা হামলায় ধ্বংস করে ফেলা হয় দুটি শহরকে। এরপরই শুরু হয় আসল তর্ক-বিতর্কের!
যুদ্ধে কোনঠাসা হয়ে পড়া জাপানের আত্নসমর্পন তখন শুধুই সময়ের ব্যাপার, তাহলে মার্কিনিদের এমন হামলার আসলেই কি দরকার ছিল? পারমাণবিক হামলা গুলো আসলেই কি যৌক্তিক? ‘হিরোশিমা ও নাগাসাকি’তে বোমা হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও আমাদের চার পর্বের লেখাটি মূলত ‘হিরোশিমা ও নাগাসাকি’কে কেন্দ্র করে যার প্রথম পর্ব ‘হিরোশিমা’র গল্প-১’ ও দ্বিতীয় পর্ব ‘হিরোশিমার গল্প-২’ এ আমরা শুরুর দিকের ও হিরোশিমাতে হামলার বিষয়গুলো বর্ননা করেছি।
তারই ধারাবাহিকতায়, সেই ভয়াবহ স্মৃতিবিজড়িত পারমাণবিক বোমাবর্ষনের কারণসমূহ, ঠিক আগ ও পরমুহূর্তের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, তখনকার শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও পরিণতি সহ আরো বেশকিছু বিষয় নিয়ে ইতিহাসপ্রেমী লেখারপাতা’র পাঠকদের জন্য সাজানো ধারাবাহিক এই সিরিজের আজ তৃতীয় পর্ব ‘নাগাসাকি’র গল্প-১’!

হামলার কারন
তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমান শুধু হিরোশিমাকে ধ্বংস করেই খুশি থাকতে পারেননি, জাপানের হাতে আত্নসমর্পনের সময় থাকা সত্ত্বেও অথবা হিরোশিমায় হামলার ধাক্কায় দিশেহারা হয়ে পরা জাপানকে কোন সু্যোগ না দিয়েই তিনি সেখানে দ্বিতীয় আরেকটি হামলার পরিকল্পনা করছিলেন! কিংবা বলা যায় প্রেসিডেন্ট ট্রুমান তাদের হাতে থাকা অন্য আরেকটি শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাট-ম্যান’ (Fat Man) এর প্রয়োগ করে দেখতে চাচ্ছিলেন।
জাপানের প্রতি আমেরিকার এমন আক্রোশ বা বিদ্বেষের কারনও কিন্তু রয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই জাপানের কিছু একরোখা আর আক্রমানাত্নক কর্মকান্ড আমেরিকা ভালো চোখে দেখছিল না। ধীরে ধীরে এই দুই দেশের ব্যবসায়িক ও অন্যান্য খারাপ সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে আমেরিকার প্রধান নৌঘাটি পার্ল হারবারে (Pearl Harbor) অতর্কিতভাবে হামলা করে বসে! প্রায় ৩০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান নিয়ে জাপান এ আক্রমন চালায়।

অতর্কিত এই আক্রমনে আমেরিকার প্রায় ২৪০০ সেনা ও নাবিক নিহত হয়, আহত হয় আরো ১২০০। আমেরিকার বেশকিছু যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজের ধ্বংস সহ আরো বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রথম এ হামলার পরেও আরো একবার জাপান এরকম আরেকটি হামলা চালানোর চেষ্টা করে, যদিও সে হামলা পরে ব্যর্থ হয়!
আমাদের লেখা যেহেতু নাগাসাকি কেন্দ্রিক তাই সেদিকে আমরা আর বেশিদূর যাব না। ইনোলা গে’র পাইলট পল তিবেটস ও তার সতীর্থদের সফলতার জন্য আনন্দ উৎসব আর জাপানকে চরম শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে নাগাসাকিতে দ্বিতীয় হামলার প্রস্তুতি একই সাথে চলছিল!
নাগাসাকিতেই কেন?
জাপানের কিছু শহরে পারমাণবিক বোমা হামলার মিশন হিরোশিমা শেষ করে এবার নাগাসাকিতে এল। মিশনের একদম প্রাথমিক অবস্থাতেই হিরোশিমা সহ মোট পাচটি শহরকে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়; হিরোশিমা ছাড়াও অন্য লক্ষ্য গুলো ছিল- ইয়োকোহামা, কিয়োতো, নিগাতা এবং কোকুরা। হিরোশিমা মিশন সফলভাবে শেষ হলে কোকুরাকে (Kokura) পরের মিশনের লক্ষ্য ধরা হয় এবং এর বিকল্প হিসেবে রাখা হয় পাশেরই আরেকটি শহর নাগাসাকিকে। কোকুরা শহরে হামলার তারিখ নির্ধারন করা হয় ১৯৪৫ সালেরই ১১ আগস্ট, কিন্তু আবহাওয়া জনিত কিছু সমস্যার কারনে সেটা ৯ তারিখে এগিয়ে নিয়ে আসা হয়!
হামলার প্রস্তুতি ও অন্যান্য
১৯৪৫ সালের ৯ই আগস্ট অর্থাৎ হিরোশিমা হামলার ঠিক তিনদিন পরেই মেজর চার্লস সুইনি (Major Charles Sweeney) বক্সকার (Bockscar) নামের আরেকটি বি-২৯ যুদ্ধ বিমান নিয়ে রাত ৩:৪৯ এর দিকে টিটিয়ান দ্বীপ ছেড়ে বেড়িয়ে পরেন! তার সাথে করে বয়ে নিয়ে যান লিটল বয়’র থেকেও ভয়ংকর ও শক্তিশালী প্লুটোনিয়াম-২৩৯ এর একটি বোমা, নাম ‘ফ্যাট-ম্যান’ (Fat Man)।

প্রায় ১০,০০০ পাউন্ড ওজন আর ২২ কিলোটন সমতুল্য একটি পারমাণবিক বোমার জন্য এমন নামই সার্থক ছিল। বাড়তি ওজনের এই বোমা নিয়ে টেক-অফ করার সময় নাকি বক্স-কারকে ভালোই বেগ পেতে হয়েছিল।
ফ্যাট-ম্যানের দিকে এক নজরঃ
-ওজনঃ চার হাজার ৬৩০ কেজি, দৈর্ঘ্যঃ১০.৬ ফুট, পরিধিঃ৩৬ ইঞ্চি
-তেজষ্ক্রিয় পরমাণুঃ প্লুটোনিয়াম-২৩৯
-বহনকারী বিমানের নামঃ বি-২৯ (বক্সকার)
-বিমানের পাইলটঃ মেজর চার্লস সুইনি

কোন রকম টেক-অফ করার পর বক্সকার তার প্রথম লক্ষ্য কোকুরা শহরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। খারাপ আবহাওয়ার জন্য মিশনের তারিখ এগিয়ে আনা হলেও সেদিনও যে আবহাওয়া খুব ভালো ছিল তা কিন্তু না, মাঝারি বৃষ্টি আর বাতাস হয়েই যাচ্ছিল। আবহাওয়া ক্রমশই খারাপের দিকেই যেতে থাকে এবং একই সাথে বিমানের ভিতরে ত্রুটি দেখা দেয়!
ফ্যাট-ম্যান এর সাথে লাগোয়া ফায়ারিং সার্কিট (Firing Circuit) অকেজো হয়ে গিয়ে বিমানের ভিতরেই বিস্ফোরনের উপক্রম হয়, ভয়ংকর ভাবে লালবাতির অ্যালার্ম বেজে ওঠে! দিশেহারা হয়ে বক্সকার এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিখ এল আশওয়ার্থ এবং তার সহকারী দুইজন মিলে ফায়ারিং সার্কিটটি সারাতে সক্ষম হয়!
শাসরুদ্ধকর এক অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে বক্সকার কোকুরা শহরের উপর গিয়ে অবস্থান নেয়, কিন্তু সেখানে যেতে যেতে আবহাওয়ার এতটাই অবনতি হয় যে, ভারী মেঘ আর ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানোর কারনে নিচের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অনেক মুল্যবান সময় আর জ্বালানি নষ্ট হতে থাকে। এভাবে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মেজর সুইনি সু্যোগ খুজতে থাকে কিন্তু এরই মধ্যে অন্য বিমান থেকে খবর আসে যে, জাপানি বিমান বাহিনী টের পেয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এরপর সুইনি আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে হতভাগা শহর নাগাসাকি’র দিকে ছুটে যায়!

নানান প্রতিকুলতা পেড়িয়ে মেজর সুইনি তার দলবল নিয়ে নাগাসাকির আকাশে এসে উপস্থিত হয়। এরই মধ্যে নষ্ট হয়েছে মূল্যবান বেশকিছু সময়, হাতে আছে প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য জ্বালানি আর শত্রু পক্ষও চলে আসতে পারে যে কোন মুহূর্তেই! কিন্তু এসব ভেবে সুইনির থেমে গেলে চলবে না, কেননা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের তখনও পুরোটাই বাকি!
শেষ পর্ব পড়ুন এখানে – ‘নাগাসাকি’র গল্প-২’
Featured image source: ThoughtCo.com