১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, ভোর ৫:২৯ মিনিট; চোঁখ ধাধানো উজ্জ্বল আলো, বিকট শব্দ এবং প্রচন্ড উত্তাপে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমির একাংশ ছেয়ে গেল – ঘটল পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ! এই বিস্ফোরণটির মধ্য দিয়ে ম্যানহাটন প্রকল্পের (Manhattan Project) ‘কোড ট্রিনিটি’ (Trinity) নামক প্লুটোনিয়াম ইমপ্লোশন বোমার পরীক্ষা একটি অত্যাশ্চর্যজনক সফলতা পায়। প্রায় ২০,০০০ টন টিএনটি (TNT) এর সমান শক্তিশালী একটি বিস্ফোরন ঘটে, যা ছিল জেনারেল গ্রোভ ও প্রকল্পটির অন্যান্য নেতাদের কাছে প্রত্যাশাতীত, একই সাথে তারা পেয়েছিলেন এক অন্যরকম স্বস্তি ও আনন্দ। তবে কেউ কেউ এ দৃশ্যে অশুভ ছায়াও দেখতে পেয়েছিলেন!

পরীক্ষামূলক ওই বিস্ফোরণটি ঘটানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই দীর্ঘ ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার পরে কিছুটা দ্রুত শেষ করতে ও প্রতিশোধ স্বরুপ তৎকালীন নব দায়িত্ব নেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘হ্যারি ট্রুমান’ (U.S President Harry Truman) জাপানের কিছু শহরে পারমানবিক বোমা ফেলার এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন! ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের ‘হিরোশিমা ও নাগাসাকি’ শহরকে পরমাণু বোমায় ধ্বংস করে ফেলা হয়! এরপর ভয়ংকর এক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
যুদ্ধের একদম শেষলগ্নে এসে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। ‘হিরোশিমা ও নাগাসাকি’র সেই ভয়াবহ স্মৃতিবিজড়িত পারমাণবিক বোমাবর্ষনের কারণসমূহ, ঠিক আগ ও পরমুহূর্তের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, তখনকার শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও পরিণতি সহ আরো বেশকিছু বিষয় নিয়ে ইতিহাসপ্রেমী লেখারপাতা’র পাঠকদের জন্য সাজানো ধারাবাহিক চার পর্বের আজ প্রথম পর্ব ‘হিরোশিমা’র গল্প-১’!

হামলার কারন/পটসডাম ঘোষণা
১৬ই জুলাই নিউ মেক্সিকোর প্রান্তরে ট্রিনিটি পরীক্ষাটি অপ্রত্যাশীত সাফল্য পেলে ২৬শে জুলাই মিত্র শক্তির নেতারা সম্মিলিত হয়ে ‘পটসডাম’ ঘোষণা পত্র (Potsdam Declaration) জারি করেন, যেখানে স্পষ্টতই জাপানকে আত্নসমর্পন করতে বলা হয়! এখানে উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম অক্ষশক্তি জার্মানি ইতোমধ্যে ১৯৪৫ সালের ৮মে আত্নসমর্পন করলে মিত্র শক্তির সম্পূর্ন লক্ষ্য তখন আরেক বেপরোয়া অক্ষশক্তি জাপানের উপর গিয়ে পড়ে, এরই ফলস্বরুপ পটসডাম ঘোষণা পত্র জারি করা হয়।
ঘোষণা পত্রে চুড়ান্তশর্ত ও হুমকি স্বরূপ জানানো হয়, আত্নসমর্পন না করলে মিত্র বাহিনী অতি দ্রুত ‘জাপান আক্রমন করবে এবং সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দিবে’ (Prompt & Utter Destruction), যদিও সে ঘোষনায় পারমানবিক বোমার কোন কথা উল্লেখ করা ছিল না!
১৯৪১ সালের দিকে যুদ্ধের সময় ভালো অবস্থানে থাকা, আধিপত্য বিস্তার করা ও সাম্রাজ্যবাদী জাপান শেষের দিকে কোনঠাসা হয়ে পরলেও সে ঘোষণা জাপান মেনে নেয়না বরং পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে তারা আরো মারাত্নক হয়ে পরে। শেষে ২৮শে জুলাই জাপান সরকারি ভাবে আত্নসর্পনের সেই দাবি ও হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়!
হামলার অনুমতি
জাপান যখন পটসডাম ঘোষনার ‘তাৎক্ষনিক ও সম্পূর্ন ধ্বংস’ হুমকি সম্পুর্নভাবে প্রত্যাখ্যান করে, মার্কিন জেনারেল গ্রোভস (General L.R Grove) তখন পারমানবিক বোমা হামলার একটি খসড়া তৈরি করে তাতে, প্রেসিডেন্ট ট্রুমান সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন কয়েকজনের স্বাক্ষর নিয়ে ম্যানহাটন প্রকল্পের নব্য আবিষ্কৃত পারমাণবিক অস্ত্র ‘লিটল বয়’কে (Little Boy) হিরোশিমায় নিক্ষেপ করার সরকারিভাবে অনুমোদন নেয়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই এই ধ্বংসাত্নক মারণাস্ত্রকে তৈরী করা হয়েছিল!

হামলার প্রস্তুতি ও অন্যান্য
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট রাত আনুমানিক ২:০০ টায় বি–২৯ নামের একটি আমেরিকান বোমারু বিমান মেরিয়ানাসে অবস্থিত উত্তর প্যাসিফিক দ্বীপ টিটিয়ান ছেড়ে উড়ে যায়। গোপন এই মিশনটি সম্পূর্ন সুষ্ঠভাবে নিশ্চিত করতে ১২ সদস্যের একটি দল প্লেনটিতে যাত্রা করে। প্লেনটির পাইলট ও দলনেতা কর্নেল পল তিব্বেটস তার মায়ের নামের সাথে মিল রেখে বি–২৯ প্লেনটির নাম দেন ‘ইনোলা গে’ (Enola Gay)। উড্ডয়নের ঠিক আগে এই নামটি বিমানের গায়ে এঁকে দেয়া হয়।

ইলোনা গে বি-২৯ একটি সুপারফোরট্রেস বিমান যা পারমানবিক বোমার মত ভারী ও শক্তিশালী বোমা বহন করার মত সুপার ইঞ্জিন দিয়ে তৈরী করা হয়, এছাড়াও যুদ্ধবিমানটির খুব দ্রুত গতি তুলতে পারার ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। ইনোলা গে’র পাশাপাশি আরো দুটি যুদ্ধবিমান বিমান ক্যামেরা ও পরীক্ষা চালানোর জন্য বিভিন্ন পরিমাপক যন্ত্র নিয়ে সাথে ছিল।
শুধু ইনোলা গে’র সাথেই ছিল দশ ফুট আর ১৩ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য একটি শক্তিশালী পারমানবিক বোমা। নাম ‘লিটল বয়’। লিটল বয় ‘ইউরেনিয়াম-২৩৫’ ইউরেনিয়ামের একটি তেজষ্ক্রিয় আইসোটপ ব্যাবহার করে তৈরী করা হয়েছিল। ইউরেনিয়াম-২৩৫ নামের এই বোমা তৈরীর রিসার্চে খরচ হয়েছিল প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কোন রিসার্চে মিলিয়ন ডলার খরচ করার ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।
লিটল বয়ের দিকে এক নজরঃ
-ওজনঃ চার হাজার কেজি, দৈর্ঘঃ ৯.৮৪ ফুট, পরিধিঃ ২৮ ইঞ্চি
-তেজষ্ক্রিয় পরমাণুঃ ইউরেনিয়াম-২৩৫
-বহনকারী বিমানের নামঃ বি-২৯ সুপারফোরট্রেস (ইনোলা গে)
-বিমানের পাইলটঃ কর্ণেল পল তিব্বেটস
জাপানে হামলা চালানোর হুমকি দেয়া হলেও, কিছু বিজ্ঞানী ও রাজনিতীবিদের পরামর্শ অনুযায়ী জাপানকে বোমা হামলার কোন আগাম বার্তা বা হুশিয়ারী জানানো হয়নি! ভোর ৬:০০ টার দিকে ইনোলা গে বোমা হামলার জন্য তৈরী হয়ে যায়। সকাল ৭:০০টায় জাপানের রাডারে একটি যুদ্ধ বিমান ধরা পড়ার সংকেত পাওয়া যায় এবং সেটি হিরোশিমার দিকে উড়ে যায়। জাপানের আকাশে তখন যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা, হিরোশিমাবাসী ভেবেছিল এটাও তেমনি এক মহড়া!

হামলার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া
সকাল ৮:১৫ নাগাদ ইনোলা গের দরজা খুলে ‘লিটল বয়’কে ফেলা হল! প্রচন্ড গতিতে বোমাটি নিচের দিকে নামতে থাকে, মাত্র ৫৭ সেকেন্ড পরে হিরোশিমা শহরের ১৯০০ ফুট উপরে বিকট শব্দে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়, যা ছিল লিটল বয় এর মূল লক্ষ অ্যায়োই ব্রিজ (Aioi) থেকে মাত্র ৮০০ ফুট দুরে! কেঁপে উঠল হিরোশিমা শহর, মুহূর্তেই গোটা শহর নীল-সাদা রঙের চোখ ধাঁধানো এক আলোয় ছেয়ে গেল, বিস্ফোরণের প্রচন্ড ধাক্কায় শহরের সবকিছু একেবারে মাটির সাথে মিশে গেল! এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে বিস্ফোরনের ফায়ারবলটি ৯০০ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়, বিস্ফোরনের ধাক্কায় ১০ মাইল দূরের ঘরবাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে এবং ৩৭ মাইল দূর পর্যন্ত ধাক্কাটি অনুভূত হয়!

ইনোলা গে ও তার সাথে থাকা অন্য ক্রু-মেম্বাররা দেখছিল, খুব দ্রুত বড় হতে থাকা তীব্র আগুন ও ঘন ধোঁয়ার মেঘ উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে! স্টাফ সার্জন জর্জ ক্যারন বর্ননা করেন –
“আমরা দেখলাম মাশরুমের আকৃতির আর বেগুনি-ধূসর ঘন ধোঁয়ার একটি বুদ বুদ যা গোলাকৃতি নিয়ে চারিপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং একই সাথে উপরে উঠছে! ধোঁয়ার ভিতরে লাল কোরের তীব্র আগুন যেখানে পুড়ো শহরটা জ্বলছিল!”
সহ-পাইলট রবার্ট লুইস তার দেয়া বর্ণনায় বলেছিলেন –
“দুই মিনিট আগেও আমরা উপর থেকে পরিষ্কার একটি শহর দেখতে পেয়েছি, সেখানে এখন পুরোটাই শূন্য! চারপাশে শুধু আগুন আর ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না!”
আগ্নেয়গিরির লাভার মত শক্তিশালী ধোঁয়ার মেঘ আনুমানিক প্রায় ৪০,০০০ ফুট উপরে উঠে গিয়েছিল। বিস্ফোরনের তাপমাত্রা এক মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায় যা আগুনের গোলার মত হয়ে চারপাশের বাতাসের সাথে জ্বলছিল! মানুষের আর্তনাদ আর চিৎকারে হিরোশিমার আকাশ ভারী হয়ে ওঠে, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝলসে যাওয়া মানুষ গুলো শুধু পানি-পানি বলে চিৎকার করতে থাকে। পানি এনে দেয়ার মত কোন মানুষ সেখানে অবশিষ্ট ছিল না! হিচিমিয়া নামের নদীর পানিও তখন প্রচন্ড উত্তাপে টগবগ করছিল!
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে – ‘হিরোশিমার গল্প-২’
Featured image source: The Independent