মানুষখেকো শব্দটা শুনলেই আমরা কেমন যেন আঁতকে উঠি! বাঘ, সিংহ, কুমির, হাঙর এ নাম গুলো আমরা কিছুটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলেও মানুষখেকো শব্দটাই মনে যেনো কেমন একটা শিহরণ জাগায়! একটা আতংক এসে জড়িয়ে ধরে। মানুষকে যখন কোন প্রানী বা জন্তুর খাদ্য হতে হয় তখন আতংকিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ‘মানুষখেকো’ বলতে ঐসব প্রানীকে বোঝায় যারা মানুষকে ভক্ষণ করার জন্য হত্যা করে। আসলে, খাওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষকে হত্যা করার প্রানীদের সংখ্যা খুবই বিরল! অনেক প্রাণীই আছে যারা নানা কারনে মানুষের উপর আক্রমন করে। আর আগে থেকেই মৃত এমন মানুষ এর দেহ খাওয়াকেও ‘মানুষখেকো’র মধ্যে ধরা হয়না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই মানুষের মাংস খেয়ে ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে এমন কিছু প্রানীও আছে! সেসব কিছু ‘মানুষখেকো’ প্রানীর কথাই আমরা আজকে জানব!
০১) জেভোডান এর জন্তু (Beast of Gévaudan)
কুখ্যাত সব ‘মানুষখেকো’ দের মধ্যে অন্যতম এবং রহস্যময় এই জন্তুটি (অনেকেই দুটির দাবি করেন) ফ্রান্সের জেভোডান (Gévaudan) প্রদেশে ১৭৬৪ থেকে ১৭৬৭ পর্যন্ত ত্রাস ছিল! ১৭৬৪ সালের গ্রীষ্মকালে মেরি জিন (Marie-Jeanne Valet) নামের কম বয়সী একটি মেয়ে প্রথম এই জন্তুর হামলার শিকার হয়। মেয়েটি জেভোডান এর পূর্ব অংশের ল্যাংগোন শহরের কাছে মারকোয়ার জঙ্গলে (Mercoire forest) গবাদিপশু চড়াতো। এর কিছুদিন পরেই ল্যাংগোন শহরেরই আরেকটি গ্রাম হুব্যাকসে (Les Hubacs) জেন বোওলেট (Janne Boulet) নামের ১৪ বছরের একটি ছেলে জন্তুটির হাতে নিহত হয়। জন্তুটি প্রায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার এর বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে ঘন ঘন আক্রমন চালাতে থাকে, গবাদি পশু পাখি রেখে সে শুধু মানুষ ভক্ষনে মেতে ওঠে!
সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা কালো লোমশ বিশাল নেকড়ের মত, মুখের আর জিহ্বার দিকে লাল, বাঘের চেয়ে বড় তীক্ষ্ণ দাত আর লম্বা লেজ ওয়ালা এক প্রানীর বর্ননা দেন। প্রানীটির শরীরে নাকি উৎকট একটা গন্ধও পাওয়া যেত। অন্তত ২১০ জন মানুষকে আক্রমনের বর্ননা পাওয়া যায় যাদের মধ্যে ৯৮ জনকেই প্রানীটি খেয়ে ফেলে আর ১১৩ জন ভুক্তভোগী মারা যায়! প্রকৃতপক্ষে এমন কোন প্রানীর হদিস পাওয়া না গেলেও ১৭৬৭ সালে জিন ক্যাস্টেল (Jean Chastel) নামের এক শিকারী ফ্রান্স রাজ্যের সহায়তায় বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে বড় নেকড়ে সাদৃশ্য এক জন্তুকে হত্যা করে এবং এর পেট কেটে মানুষের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে যা প্রানীটিকে ভয়ংকর সেই ‘মানুষখেকো’ হিসেবে নিশ্চিত করে!

০২) নজোম্বির সিংহ
এটি ১৯৩২ সালের তানজিনিয়ার নজোম্বি (Njombe) শহরের কাছের ঘটনা। এখানে একটি বা দুটি প্রানী নয়, পুরো একটি সিংহের দল দম্ভের সাথে নির্মমভাবে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল! তাদের অন্যান্য সব খাবারের চেয়ে মানুষের মাংসই ছিল বেশি পছন্দের। ‘মানুষখেকো’ সিংহের দলটি এতটাই হিংস্র ছিল যে ধারাবাহিক আক্রমণে প্রায় ১৫০০ মানুষের জীবন নেয় ( কোন কোন মতে ২০০০টি ); যা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সিংহ বা অন্য যে কোন প্রানীর হত্যাকান্ডের চেয়ে বেশি!
নজোম্বির স্থানীয় জনশ্রুতিতে আছে যে, ‘মাতামুলা মঙ্গেরা’ (Matamula Mangera) নামের এক জাদুকর ওঝা সিংহের দলটিকে নিয়ন্ত্রন করত। তারা ভয়ে এবং আতঙ্কে সেসময়ে সিংহের নামও মুখে আনত না। অবশেষে বিখ্যাত শিকারি জন রুশবি (George Gilman Rushby) সিংহের এই তান্ডব বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একে একে ১৫টি সিংহকে হত্যা করতে সক্ষম হন। আর বাকি কিছু সিংহ ওই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে গেলে স্থানীয়দের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটে।

০৩) দুই আঙ্গুলওয়ালা টম (Two-Toed Tom)
২০ এর দশকে আলাবামা এবং ফ্লোরিডা সীমান্তের বিভিন্ন জলাশয়ে অতিকায় এক পুরুষ কুমিরের ঘোরাফেরা ও ‘মানুষখেকো’ হয়ে ওঠার কথা শোনা যায়! স্থানীয় লোকেদের পাতা লোহার একটি ফাঁদে কুমিরটি আটকা পড়লেও কাদা পানিতে ধস্তাধস্তি করে সে পালিয়ে যায় কিন্তু তার দুটি বাদে পায়ের প্রতিটি আঙ্গুলই ওই ফাঁদে কাটা পরে। এরপর থেকেই কুমিরটির নাম হয় ‘দুই আঙ্গুলওয়ালা টম’। জনশ্রুতিতে পাওয়া প্রায় সারে চার মিটার লম্বা কুমিরটি কোন সাধারন কুমির ছিলনা, তাকে নরক থেকে পাঠানো কোন রাক্ষস বলে বিশ্বাস করা হত!
টম বেশ কয়েকটি গরু, শুকর এবং মানুষ খাওয়ার পরে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। পানিতে কাপড় ধুতে অথবা সাঁতার কাটতে নামা মহিলারাই বেশি তার হামলার শিকার হত। টমের উৎপাত বেড়ে গেলে কিছু স্থানীয় কৃষক তাকে বন্দুক দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু গুলি করেও টমকে তারা মারতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তিতে আরো এক কৃষক (যার মেয়েকে টম খেয়ে ফেলেছিল বলে জানা যায়) ডিনামাইট দিয়ে টমকে হত্যা করার চেষ্টা করেন, টম যে পুকুরে থাকত বলে ধারনা করা হত সে পুকুরে প্রায় পনেরটি ডিনামাইট বিস্ফোড়ন করা হয়। সেখান থেকেও টম বেঁচে পাশের আরেকটি জলাশয়ে পালিয়ে যায়!

এরপর আরো অনেক বছর টমকে ফ্লোরিডার বিভিন্ন জলাশয়ে ঘুড়তে দেখা যায়, অনেকেই তাকে লেকের পাড়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে, তার গর্জন শুনেছে, এমনকি কাদাপানি আর বালুতে হেটে যাওয়ার চিহ্নও দেখেছে! সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল টম ২০ দশকের কুখ্যাত হলেও ৮০’র দশকে আবারো তাকে একই জলাশয়ের আশেপাশে দেখা যায়। এরপরও আরো কয়েকবার তাকে শিকারের চেষ্টা করা হলেও জীবন্ত কিংবদন্তী দুই আঙ্গুলওয়ালা টম ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়!
০৪) অন্ধকার আর অশরিরী (Man Eaters of Tsavo)
১৮৯৮ সালে ব্রিটিশরা কেনিয়ার সোভো (Tsavo) নদীর উপর একটি রেলপথ নির্মানের কাজ শুরু করে। সেখানে ঠিক নয় মাস পরে দুর্ভাগা এক রেলশ্রমিক দুই নরখাদক সিংহের শিকার হন! এই সিংহ দুটি (পরস্পরের ভাই) আকারে ছিল বিশাল, প্রায় তিন মিটারের দীর্ঘ। প্রথমদিকে তারা তাঁবুর ভিতর থেকে মানুষ টেনে জংগলে নিয়ে খেয়ে ফেলত, কিন্তু শীঘ্রই তারা এতটাই হিংস্র হয়ে পরে যে তাঁবুর ভিতরেই তারা মানুষ কামড়ে খেয়ে ফেলত! সিংহ দুটির বিশাল আকৃতি সাথে বর্বরতা এতটাই মারাত্নক ছিল যে, গ্রামবাসীরা তাদেরকে পিশাচ বলে বিশ্বাস করত! তারা মনে করত ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে প্রাচীন মৃত কোন রাজার পূনর্জন্ম হয়েছে। তারাই সিংহ দুটির নাম দেয় ‘অন্ধকার’ আর ‘অশরিরী’ (The Ghost and the Darkness)।

সিংহ দুটির নরখাদকতার জন্য রেল নির্মানের কাজ বন্ধ হয়ে পরলে রেল প্রজেক্টের প্রকৌশলী প্রধান জন হেনরি পিটারসন (John Henry Patterson) ‘অন্ধকার’ আর ‘অশরিরী’কে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। বেশ কিছু চেষ্টা চালিয়ে তিনি ১৮৯৮ সালের ডিসেম্বরে একটি সিংহকে এবং তার দু’তিন সপ্তাহ পরে অন্যটিকে শিকার করতে সক্ষম হন! তিনি নিজেও কয়েকবার মরতে মরতে বেঁচে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিংহ দুটি প্রায় ১৪০ জন মানুষকে হত্যা করে! পিটারসন সিংহ দুটির ডেরাও খুজে বের করেন যেখানে প্রায় ৩৫টি মৃতদেহের দেহাবশেষ পাওয়া যায়।

০৫) নিউ জার্সির হাঙর
বাস্তবে ‘মানুষখেকো’ হাঙরের কথাটি খুব ক্ষেত্রেই শোনা যায়, বেশিরভাগ হাঙর আক্রমনই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে ১৯১৬ সালে নিউ জার্সির উপকূলে হাঙর হামলার কিছু ঘটনায় বেশ তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। চার্লস ভ্যানসেন্ট (Charles Epting Vansant) নামের এক যুবক তার পোষা কুকুরের সাথে খুব অগভীর পানিতেই সাঁতার কাটার সময় প্রথম এ হামলার শিকার হন; তার পরিবারের কয়েকজন সহ আরো কিছু প্রত্যক্ষদর্শী এ ঘটনার সময় কাছাকাছিই ছিলেন! একজন লাইফগার্ড তাৎক্ষনিক তাকে উদ্ধারে ছুটে যান এবং মারাত্নক আহত অবস্থায় চার্লসকে উদ্ধার করে, তার একটি পা হাঙরটি ছিড়ে নিয়ে যায়। এরপর হাসপাতালে নিতে নিতেই চার্লস এর মৃত্যু হয়।

পাঁচদিন বাদেই একই হাঙর ব্রুডার (Bruder) নামের একজনকে টেনে নিয়ে যায়, পরে তার দেহাবশেষ সৈকতে পরে থাকে। পরবর্তীর ঘটনা গুলি সমুদ্রে নয়, মাতওয়ান (Matawan) শহরের একটি খাঁড়িতে ঘটে। সে বছরই ১২ জুলাই এগারো বছরের এক ছেলেকে সাঁতার কাটার সময় পানির নিচে টেনে নিয়ে যায়, স্ট্যানলি ফিশার (Stanley Fisher) নামের এক ব্যাক্তি ছেলেটিকে উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাপিয়ে পরলে তাকেও হাঙরটি আক্রমন করে! মারাত্নক ক্ষত নিয়ে পানি থেকে উঠে আসতে পারলেও কিছুদিন পরেই তার মৃত্যু হয়! ফিশারের কিছুক্ষন পরেই চুড়ান্তভাবে আরেকজন একই হাঙরের শিকার হন! পরবর্তিতে ১৪ জুলাই মাতোয়ান খাঁড়ির পাশেরই উপকূলে এক স্ত্রী ‘গ্রেট হোয়াইট শার্ক’ ধরা পরে, তার পেটের মধ্যে মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল বলে শোনা যায়।

০৬) কেসাগেক
ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ভালুকের আক্রমনের কথা শোনা যায় ১৯১৫ সালে সাঙ্কেবেতসু (Sankebetsu) নামের জাপানী এক গ্রামে! জাপানের সবচেয়ে শক্তিশালী স্থল শিকারি হিসেবেও এই বাদামী রঙা ভালুকটি বিখ্যাত হয়ে আছে। সেই সময়ে সাঙ্কেবেতসু নতুন গড়া একটি গ্রাম, জঙ্গল মত সে অঞ্চলে খুব অল্প লোকই বসবাস করত। একই অঞ্চলে কেসাগেক (Kesagake) নামের এক বিশাল বাদামী ভাল্লুক ছিল, কেসাগেক ওই গ্রামে প্রায়ই কাটা ফসল বা ভুট্টা খেতে আসত। উৎপাত বেরে গেলে দুই কৃষক একদিন ভালুকটিকে গুলি করলে আহত অবস্থায় সে পালিয়ে যায়।
ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ কেসাগেক আবারো ফিরে আসে, তবে এবার আর ভুট্টা খেতে নয়! সে একটি গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকে পরে ছোট একটি বাচ্চাকে হত্যা করে, এরপর এক মহিলাকে ধরে জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরে ৩০ জনের একটি দল মহিলাটিকে খুজতে বের হলে তুষার এর নিচ থেকে মহিলাটির অর্ধ খাওয়া দেহ খুজে পায় যেটা কেসাগেক পরে খাওয়ার জন্য রেখে দিয়েছিল। এর একটু দুরেই তারা কেসাগেককে দেখতে পায় এবং গুলি করে। এবারো সে পালিয়ে যায়।

এর কিছুদিন পরে আবারো কেসাগেক ফিরে আসে এবং একটি বাড়িতে ঢুকে ছয়জন মানুষকে হত্যা করে, যার মধ্যে ছিল দুইটি শিশু আর একজন গর্ভবতী মহিলা! পুরো গ্রামটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে আর লোকজন ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর নামকরা এক ভাল্লুক শিকারিকে খবর দেয়া হলে ১৪ ডিসেম্বর সে কেসাগেককে হত্যা করে। তার পেটেও মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল! ভালুকটি ছিল লম্বায় প্রায় ৩ মিটার উচু আর ওজন ছিল প্রায় ৩৮০ কেজি।
০৭) ইন্ডিয়ান মধ্য-প্রদেশের চিতা (Leopard of Panar)
ইন্ডিয়ার কুখ্যাত ‘মানুষখেকো’ এই চিতাটি ২০ শতকের গোড়ার দিকে মাত্র দুবছরের মধ্যে প্রায় ১৫০ জন মানুষকে হত্যা করে! এর চেয়েও নৃশংস খবর হচ্ছে এই চিতাবাঘের হামলার শিকার সবাই ছিল নারী এবং শিশু! সে এতটাই বেপরোয়া ও সক্রিয় ছিল যে প্রতিদিনই অন্তত দুই থেকে তিন জনকে হত্যা করত, আর সে হামলা করত সম্পুর্ন ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় গিয়ে। সেসব অঞ্চলের মানুষ এতটাই আতঙ্কিত থাকত যে তারা অস্ত্র ছাড়া ঘর থেকে বের হত না।

অবশেষে একটি গ্যাস পাইপের সংক্রমন দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চিতা বাঘটির মৃত্যু হয়! মৃত বাঘটির পাকস্থলিতে মানুষের চুল পাওয়া গেলে এটিই সেই ‘মানুষখেকো’ বাঘ বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। তরুণ বয়সের সুগঠিত ওই বাঘটির শিকার করার ধরন দেখে পরবর্তিতে ধারনা করা হয় যে, বাঘটিকে ছোট থেকেই শিকারি হিসেবে তৈরী করা হয়েছে। কাজটি করেছিল হয়তো তার মা- সম্ভবত যে নিজেও মানুষখেকো ছিল!

০৮) চাম্পাভাট এর বাঘিনী
১৯ শতকের শেষের দিকে, হিমালয়ের নিকটবর্তী এক নেপালি অঞ্চলে একটি স্ত্রী রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর ত্রাস শুরু হয়। ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এই বাঘিনী সে অঞ্চলকে দারুন আতংকিত করে তুলেছিল! এই বাঘিনী একাধারে কয়েকডজন মানুষকে আক্রমন ও হত্যা করে। ধারনা করা হত বাঘিনীটি সব সময়ই ক্ষুধার্ত থাকত, এভাবেই সে প্রায় ২০০ মানুষ হত্যা ও ভক্ষন করে! বাঘিনীটির সন্ধানে বেশ কয়েকবার শিকারি পাঠানো হলেও প্রতিবারই তারা ব্যার্থ হয়। এরপর নেপাল সরকার সেনাবাহিনী পাঠায় বাঘিনীটিকে ধরার জন্য কিন্তু সেবার সে পালিয়ে যায়। পালিয়ে সে পাশের দেশ ভারতে ঢুকে পরে এবং সেখানেই চাম্পাভাটে (Champawat) তার তান্ডব শুরু করে।
দিনের আলোতেই সে গ্রামটির বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাতো! প্রতিটি হামলাই যেন তাকে আরো বেপরোয়া করে তোলে। শেষে অতিষ্ট ভারত সরকার বিখ্যাত জিম কর্বেটকে (Jim Corbett) তলব করেন, জিম কর্বেট বেশ কয়েকদিন বাঘিনীটির বিভিন্ন গতিবিধী পর্যবেক্ষন করেন। ছোট একটি মেয়েকে হত্যা করার জায়গা থেকে রক্ত আর পায়ের চিহ্ন অনুসরন করে জিম বাঘিনীর ডেরা খুজে বের করতে সক্ষম হন। এরপর ১৯১১ সালে তিনি বাঘিনীটিকে গুলি করে হত্যা করেন! মৃত্যু আগে পর্যন্ত বাঘিনীটি প্রায় ৪৩৬ জন মানুষকে হত্যা করে ‘মানুষখেকো’র খাতায় নিজের নাম করে নেয়!

০৯) কুমির গুস্তাভ
আফ্রিকার বুরুন্ডির কোন এক জলাভূমিতে এখনও লুকিয়ে আছে দৈত্যাকার এক কুমির, যার নাম গুস্তাভ (Gustave)। গুস্তাভ এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মানুষকে হত্যা করেছে! উপরে উল্লেখিত প্রায় সবকটি ‘মানুষখেকো’কেই হত্যা করা সম্ভব হয়েছে, দুই একটি হয়তো সময়ের সাথে হারিয়েও গিয়েছে। কিন্তু গুস্তাভ এখনো জীবিত আছে, হয়তো অপেক্ষায় আছে আরও একটি হত্যাকান্ডের জন্য! ৬ মিটার লম্বা ও প্রায় ১ টন ওজনের এই কুমিরটিকে ধরার জন্য প্রকৃতিবিদ প্যাট্রিক ফাই (Patrice Faye) বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হতে পারেননি।
গুস্তাভ এর শক্ত চামড়ায় অসংখ্য ছুরি, বর্শা আর গুলির চিহ্ন রয়েছে, তাকে হত্যা করার প্রতিটি চেষ্টাই ব্যার্থ হয়েছে। গুস্তাভকে নিয়ে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়টি হচ্ছে সে নিছক আনন্দ করার জন্যেও নাকি মানুষ খুন করেছে, আর এটা রীতিমত তার একটি অভ্যাস! একটি হত্যাকান্ডের পর সে কয়েক মাস বা বছরের জন্য কোথায় যেন নিখোজ হয়ে যায়, এরপর ফিরে এসে সে আবার আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটায়। এজন্য তার ফিরে আসার সময়টা অনুমান করাও কঠিন। বর্তমানে বুরুন্ডির মানুষের একমাত্র শত্রু এই গুস্তাভ, তাকে এখন আর হত্যা নয় বরং জীবিত ধরতেই বুরুন্ডি বাসী বেশি প্রত্যাশী।

১০) ক্যানিবালিজম বা মানুষখেকো জাতি
অনেক প্রানীই আছে যারা নিজেদের মধ্যেই কাউকে হত্যা করে এবং খাবার হিসেবে গ্রহন করে! প্রানীদের এমন আচরনকে ক্যানিবালিজম বলে। মানুষের মধ্যেও মানুষের মাংস খাওয়ার মত ভয়ংকর রীতি বা নিয়মের প্রচলন আছে যা প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যমান! এই মানুষ ক্যানিবাল রা মানুষের মাংস সহ শরীরের ভিতরের বিভিন্ন অংশ খেতে পছন্দ করে। ১৭ শতাব্দীতে ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে আইল্যান্ড ক্যারিব (Island Caribs) নামের উপজাতিদের মাঝে মানুষের মাংস খাওয়ার চর্চা ছিল বলে জানা যায়, এই আইল্যান্ড ক্যারিব থেকেই ক্যানিবালিজম নামটির উৎপত্তি ঘটে।

নিউ গিনি ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জের দিকেও বীভৎস এই মানুষ খাওয়ার চর্চা ছিল। মেলানেশিয়া আর ফিজিতে মানুষের মাংস বাজারে কিনতে পাওয়া যেত বলে শোনা যায়। মানুষ খাওয়ার অপরাধে পাপুয়া নিউ গিনিতে প্রায় ২৯ জনের একটি দলকে আটক করা হয়, কিছু ডাক্তারের রহজ্যজনক মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এদের সন্ধান পান। এ নিয়ে বিচার শুরু হলে দলটি কোর্টে নিজেদের অপরাধ ও ডাক্তারদের মাংস খাওয়ার কথা স্বীকার করেন! অন্ধবিশ্বাস আর বিকৃত মানসিকতাকেই এমন জঘন্য ঘটনার কারন বলে মনে করা হয়। অনেক নরখাদক মানুষই মানুষের মাংস সুস্বাদু আর মিষ্টি বলে পৈচাশিক বর্ননা দেন!

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ তার আশেপাশের নানান প্রানীদের সাথে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে এসেছে। হোক সেটা মানুষখেকো মানুষ বা অন্য কোন জীব! নিজেদের প্রয়োজনে আমরা যেমন অন্যসব প্রানীদের শিকার করি, প্রকৃতি একই ভাবে তা বারবার আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। আধুনিক যুগের এ সময়ে এসে আমরা এসব প্রানীদের একটু এড়িয়ে চললেও আগামীতে টিকে থাকার এমন আরো অনেক লড়াই যে কোন সময়ই হতে পারে, হয়তো নতুন বা আরো হিংস্রতম কোন প্রানীর সাথে!
Featured image source: artstation.com